Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঈদুল আজহার অর্থনীতি

Icon

মোহাম্মদ সামছুল আলম

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদুল আজহার অর্থনীতি

পবিত্র ঈদুল আজহা সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য গবাদিপশু কুরবানি করা। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলমানদের এ উৎসবের উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক না হলেও অর্থনীতিতে এর ভূমিকা অনেক। কুরবানি উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী যে লেনদেন হয়, অর্থনীতিতে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রতিবছর সারা দেশে কুরবানি উপলক্ষ্যে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। সঠিক পরিকল্পনা ও হিসাব না রাখার কারণে এ লেনদেন থেকে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে তা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ধারণা করা হয়, কুরবানি কেবল গবাদিপশুর বেচাকেনার অর্থনীতি। প্রকৃতপক্ষে কুরবানি হলো বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক তৎপরতা, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকায় আরও গতি সঞ্চার করে। এই ঈদে একদিকে যেমন গবাদিপশু ক্রয় করেন কুরবানিদাতারা, তেমনি অন্যদিকে খামারি বা প্রান্তিক কৃষকরা গবাদিপশু বিক্রি করে তাদের প্রয়োজনীয় সওদা করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মসলার বিরাট বাজার, কুরবানির পশুর খাবার, জবাই করার ছুরি-চাকু, মাংস কাটার সরঞ্জামাদি, কুরবানির পশুর মাংস কাটা ও বণ্টনের জন্য কর্মীদের আয়-রোজগার, কুরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয়। এসব মিলিয়ে চলে এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ, সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে কুরবানিকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রভাব। কাজেই দেশের অর্থনীতিতে কুরবানির অবদান অনস্বীকার্য। এ মহা কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে লাখো-কোটি মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং আয়-রোজগারের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে দেশের জিডিপিও সমৃদ্ধ হয়।

জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশে কুরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা নিরূপণ করেছে। এ বছর কুরবানিযোগ্য সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এবার হৃষ্টপুষ্টকৃত গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশুর উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়। গত বছর দেশে কুরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ; এর মধ্যে কুরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ। ২০২৪ সালে শুধু কুরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় উপলক্ষ্যে লেনদেন হয় ৬৯ হাজার ১৪১ কোটি ১২ লাখ টাকা, যার সিংহভাগই যুক্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া গত বছর অনলাইন প্ল্যাটফরমে ৪ হাজার ৭৪০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মূল্যের ৫.০৫ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে।

সরকারি নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি গরু-মহিষ, দুম্বা, ছাগল ও উটের জন্য বিক্রয়মূল্যের ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব দিতে হয়। এবার শুধু ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ থেকেই সরকারের রাজস্ব পাওয়ার কথা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। অন্য পশু মিলিয়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। এছাড়া এ বছর কুরবানি হওয়া ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষের প্রতিটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলে এর মূল্য হয় প্রায় ৫৬১ কোটি টাকা। আবার ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়ার প্রতিটির চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৬৮.৫০ কোটি টাকা। কুরবানি উপলক্ষ্যে গরু ও ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এই পুরো টাকা যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে।

অন্যদিকে প্রতিবছর ঈদুল আজহায় বছরে উৎপাদিত মোট চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশ সংগৃহীত হয়। চামড়াশিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাতগুলোর অন্যতম। আয়ের দিক থেকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের পর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। শিল্প আয়ে এ খাতের অবদান ২ শতাংশ আর রপ্তানির ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশীয় জিডিপিতে চামড়াশিল্পের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ। কুরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতটি। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়। তাছাড়া কুরবানির সঙ্গে চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। জানা যায়, দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত লবণের মজুদ রয়েছে। আগামী কুরবানির ঈদে চামড়া শিল্পের জন্য লবণের সংকট হবে না। কুরবানি উপলক্ষ্যে লবণের ব্যবসাও চাঙা হয়। চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনবলের। এ সময় শ্রমিকরা পান তাদের শ্রমের ভালো মূল্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণেও লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

কুরবানির বর্জ্যওে অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনার কথা বলছেন গবেষকরা। যে বর্জ্য ঈদ-পরবর্তী ভোগান্তির কারণ, সে বর্জ্যইে লুকিয়ে আছে শত কোটি টাকার সম্পদ! সচেতনতার অভাবে রপ্তানিযোগ্য পশুর উচ্ছিষ্ট নষ্ট হচ্ছে। কুরবানির ঈদে বর্জ্য হিসাবে হাড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, লিঙ্গ, মূত্রথলি, রক্ত, চর্বি, পিত্ত ও চামড়ার বাতিল অংশ ফেলে দেওয়া হয়। এসব উচ্ছিষ্ট শতভাগ রপ্তানিযোগ্য। জানা যায়, গরুর হাড় দিয়ে তৈরি হয় জীবন রক্ষাকারী ক্যাপসুলের কভার। নাড়ি দিয়ে তৈরি হয় অপারেশনের সুতা। চর্বি দিয়ে সাবান। নাড়িকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের জনপ্রিয় খাবার সুসেড রুল। লিঙ্গ দিয়ে তৈরি স্যুপ বিভিন্ন দেশে অভিজাত খাবার হিসাবে বিবেচিত। এর দামও বেশি। এভাবেই পশুবর্জ্য মানুষের কোনো না কোনো কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলো রপ্তানি করলে শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন, কুরবানির বর্জ্য দিয়ে উৎকৃষ্ট জৈবসার তৈরি করা যাবে, যা মাটির উর্বরতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। ছাগল, ভেড়া, মহিষের উচ্ছিষ্টাংশ ব্যবহার করে দেশের পশু ও মৎস্য খাদ্যের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা যায়।

অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিপুল সম্ভাবনার উৎস এ কুরবানির ঈদ। এ ঈদকে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু থাকায় চলতি বছর কুরবানি ঈদের জন্য পশু আমদানি করা হবে না। অবৈধপথে কোনোভাবেই গবাদিপশু প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এমনকি কুরবানি শুরুর এক মাস আগে ৪ মে থেকেই গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ আছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। কুরবানির ঈদের বাজার যেন কেউ অস্থিতিশীল করতে না পারে, চাঁদাবাজির কারণে পশুর দাম যেন না বাড়ে সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। এছাড়া গবাদিপশুর মধ্যে স্টেরয়েড ও হরমোন ব্যবহার রোধে সচেতনতা সৃষ্টি ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এজন্য সারা দেশে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কুরবানিযোগ্য গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সর্বোপরি, সরকারের নানামুখী উদ্যোগে বাংলাদেশ এখন গরু-ছাগল তথা মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এতে করে দেশের গবাদিপশু দিয়েই দেশের কুরবানির চাহিদা একদিকে যেমন মেটানো যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল হচ্ছে।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ সামছুল আলম : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

ঈদুল আজহা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম