বৈশ্বিক প্রভাব হারাচ্ছে আমেরিকা
কার্ল বিল্ডট
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা কি এমন এক যুগে প্রবেশ করতে চলেছি, যখন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব কমে যাবে? প্রশ্নটি অদ্ভুত শোনালেও আমেরিকা এখনো বিশ্বের প্রধান সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি, রিজার্ভ-মুদ্রা ইস্যুকারী এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি। তবে যুক্তরাষ্ট্র যখন তার বিশ্বব্যাপী ভূমিকাকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন ধীরে ধীরে এটি তার অনেক ক্ষমতা ও প্রভাব হারাবে, যা এখন সে স্বাভাবিকভাবেই ধারণ করে।
নিশ্চিতভাবেই আমেরিকার ক্ষমতা ও প্রভাব ইতোমধ্যেই কমে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থাকে নিজের স্বার্থে গঠন করতে পারত; এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বল্পকালীন ‘একমেরুকেন্দ্রিক’ ব্যবস্থা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এরপর থেকে অন্যান্য শক্তিও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং তাদের বিশ্বব্যাপী আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করছে। এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে চীন, পাশাপাশি ইউরোপও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব খেলোয়াড় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঐক্যের খোঁজে রয়েছে। অনেক মাঝারি শক্তিও তাদের গুরুত্ব বাড়াতে চায়।
এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার পশ্চাৎপদ গতি ত্বরান্বিত করেছেন। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রশাসনের বিশ্বব্যাপী দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার বিষয়টি কারও জন্য আশ্চর্যের নয়, তবে এ পরিবর্তনের গতি অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যবস্থায় একটি বৃহৎ শূন্যস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
স্পষ্টতই, ট্রাম্পের চিন্তাধারায় কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে আছে বাণিজ্য। তিনি বুঝতে পারেননি, বাণিজ্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপকৃত করতে পারে। বরং তিনি এটিকে একটি ‘জিরো সাম গেম’ হিসাবে দেখেন, যেখানে আমেরিকা হেরে যাচ্ছে। অর্থনীতির মৌলিক নীতির (এবং সাধারণ জ্ঞানের) পরিপন্থি হলেও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না।
কেউ, এমনকি ট্রাম্পও, জানেন না ‘আমেরিকা মুক্তি দিবস’ (২ এপ্রিল) থেকে শুরু করা বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে কী ফলাফল আসবে। তবে একটি বিষয় ইতোমধ্যেই স্পষ্ট : বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার ভূমিকা কমে যাবে; কারণ তার সঙ্গে বাণিজ্য করা (বিশ্বাস স্থাপন করা তো দূরের কথা) কঠিন হয়ে উঠবে।
বাস্তবে, যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শক্তি হলেও দেশটির জিডিপিতে বাণিজ্যের অংশ চীন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো নয়। চীন প্রায় ১২০টি দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রায় ৮০টির, যেখানে আমেরিকা মাত্র ২০টির। আর এখন যখন ট্রাম্প বন্ধু ও শত্রু উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক শুল্কারোপ করেছেন বা আরোপের হুমকি দিয়েছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দুর্বল হবে।
বহুজাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যবস্থার ভেতর ও বাইরে আমেরিকার অনুপস্থিতি আরও স্পষ্ট হবে। এখন যখন ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, তখন চীন সংস্থাটির একক বৃহত্তম অর্থদাতা হিসাবে এগিয়ে এসেছে। অন্যরাও আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী উদ্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে বাধ্য হবে, যা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার তহবিলের ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং এখন দ্রুত কমছে।
ট্রাম্প যখন পানামা খাল, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি দিচ্ছেন, তখন আমেরিকার কূটনীতি ব্যাপকভাবে পশ্চাৎপদ অবস্থানে রয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাশিয়ার ইউক্রেন হামলাকে ‘জো বাইডেনের যুদ্ধ’ বলছেন এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার সময় তারা প্রথমে ঘোষণা করেছিলেন এটি আমেরিকার কোনো বিষয় নয়। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফর ছিল কেবলই ব্যবসা, বিনিয়োগ ও অস্ত্রচুক্তি সুরক্ষার জন্য। গাজাকে একটি রিসোর্টে পরিণত করার অদ্ভুত বক্তব্যের বাইরে তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিন প্রশ্নটি মূলত উপেক্ষা করেছেন, যার ফলে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইচ্ছামতো নীতি গ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ পিছু হটা বিপজ্জনক হতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কিছু না করত, তাহলে কী হতো? এমনকি ট্রাম্পও ইরানের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক চুক্তি করার যুক্তি বুঝতে পারছেন, যাতে নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত যুদ্ধ না হয়। কিন্তু এই একটি কূটনৈতিক ঘটনা ব্যতিক্রম মাত্র এবং ট্রাম্প সেগুলো থেকে সরেও যেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটার এ প্রবণতায় কিছু রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় অনুঘটক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করবে, যা বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে।
এ শূন্যস্থান পূরণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পষ্টতই একটি প্রার্থী। তার একটি অনন্য সুযোগ রয়েছে কম আমেরিকাকেন্দ্রিক বাণিজ্যব্যবস্থায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার। অন্যদিকে চীন জাতিসংঘ ব্যবস্থায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। সেখানে শক্তির পুনঃসমতা দরকার এবং সম্ভবত তা অনিবার্য, যা ‘গ্লোবাল সাউথে’র প্রভাব বাড়ানোর মাধ্যমে দ্রুততর হতে পারে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার নিজস্ব ভূমিকা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
অতএব চীনা-ইউরোপীয় সম্পর্কের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। যদি গত তিন বছরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়াকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা না দিতেন, তাহলে আগামীর পথ আরও স্পষ্ট হতো। পরিস্থিতি জটিল হলেও চীন ইচ্ছা করলে এখনো দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে। আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো, ন্যাটো কীভাবে অভিযোজিত হবে, যখন আমেরিকার সামরিক সম্পদ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরবে (অথবা পূর্ব এশিয়ার দিকে সরানো হবে)। স্তরবিন্যাসকৃত অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি ‘গোল্ডেন ডোম’ তৈরির ট্রাম্পের প্রস্তাব আমেরিকার বিচ্ছিন্ন থাকার একটি নিখুঁত প্রতীক। ডোমের বাইরে আমেরিকার প্রভাব-পরবর্তী বিশ্বের ভবিষ্যৎ অজানা।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনূদিত
কার্ল বিল্ডট : সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
