Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দৃষ্টিপাত

শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে

Icon

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে

মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাঙ্গনে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে কখনোই সুষ্ঠুভাবে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজন হলেও সত্যি, আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে এক ধরনের নৈরাজ্য এবং ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে।

অতীতে গণআন্দোলনের পর প্রতিবারই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে গেছে এবং শিক্ষা গ্রহণে মনোযোগী হয়েছে। কিন্তু এবার তার ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টের সংঘটিত সফল গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। প্রথমে তারা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীকালে তা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে মরণপণ আন্দোলন শুরু করে।

এ আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল : এবারই প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সরকার পতনের আন্দোলনে শরিক হয়। এতে আন্দোলন বেগবান হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। আন্দোলন চলাকালে এক হাজারেও বেশি ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই সরকার পতনের আন্দোলনে এত বেশিসংখ্যক মানুষ নিহত হয়নি। আন্দোলন চলাকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। একটি স্বাধীন দেশে আন্দোলন দমনের নামে এমন নির্মমতা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এ সফলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সফল আন্দোলনের পর দেশের শিক্ষাঙ্গনে সহসাই শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং পরিস্থিতি দিন দিনই ঘোলাটে হচ্ছে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। একে কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ বলা যাবে না।

শিক্ষাঙ্গনে কখন স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশে ফিরে আসবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। দেশে যদি শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ না থাকে, তাহলে সেই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা মানবিক গুণাবলি নিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না, কাঙ্ক্ষিত মানবিক সমাজ গঠন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। গুণগত শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে শান্তিপূর্ণ এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা।

শিক্ষাঙ্গনে যদি এ বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে দেশ ও জাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হবে। কারণ শিক্ষা বিস্তারের জন্য সুস্থ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক পরিবেশ খুবই প্রয়োজন। অস্বাভাবিক পরিবেশে কখনোই জ্ঞানচর্চা করা যায় না। শিক্ষার্থীদের যেসব দাবি আছে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। একাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় না থাকলে ‘বিশেষ মহলে’র উদ্দেশ্য সাধিত হবে। যারা আমাদের প্রতিপক্ষ আছেন, তারা চান না বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় থাকুক, এ দেশের মানুষ উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক। বিগত সরকার আমলে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পরিবর্তে শুধু পাশের হার বাড়ানোর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। কোন্ বছর কতসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ+ পেল, সেটাই বিবেচনা করা হতো। শিক্ষার মান কোথায় নেমে যাচ্ছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

স্বাধীনতার পর শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে নানাভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়। সরকারের ছত্রছায়ায় সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার আগেও স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশিশক্তির প্রভাব লক্ষ করা যেত। তবে সেই সময় সাধারণত হকিস্টিক বা এ জাতীয় উপকরণ দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর শিক্ষাঙ্গনে মারণাস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজি মো. মহসিন হলে সেভেন মার্ডারের কথা নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তৎকালীন সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা সেই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছিল।

দেশে যখন স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকে, তখন শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাড়ে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা দেখা যায়। স্বাধীনতা অর্জনের পর আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দাপট লক্ষ করা গেছে। এরশাদ আমলে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটানো হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামল। এ সময় ছাত্ররাজনীতিকে সবচেয়ে কলুষিত করা হয়েছে। পতিত সরকারের ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তারা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ক্যাম্পাসে রাজনীতি চর্চা দূরে থাক, সহাবস্থানও করতে দেয়নি। নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় তারা ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে দেয়নি। ওই সময় জাতীয় রাজনীতিও কলুষিত করা হয়েছিল। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল; ঠিক একইভাবে শিক্ষাঙ্গনে ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনীতিচর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে।

অতীতে কখনো কখনো এমন সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সেই অনুকূল পরিবেশ বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ৪০ বছর শিক্ষার সুন্দর এবং অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল। সেশনজট বলতে কিছু ছিল না। ছাত্র সংগঠনগুলো ভিন্নমত ধারণ করলেও তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল লক্ষ করার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি। তাদের অধীনে জ্ঞানচর্চা করে অনেকেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। নতুন নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন করেছেন। এটি সম্ভব হয়েছিল এ কারণেই যে, তখন দেশে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ছিল।

ভারত বিভক্তির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন আন্দোলন করেছে। ছাত্ররাই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। বাষট্টি সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ’৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্ররা গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছে। কিন্তু প্রতিবারই আন্দোলনের পর ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে ফিরে গিয়ে আবারও জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হয়েছে। অর্থাৎ আন্দোলন-সংগ্রাম যাই হোক, ছাত্ররা তাদের মূল দায়িত্ব জ্ঞানার্জন থেকে কখনোই দূরে সরে যায়নি। কিন্তু এখন আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষয়িক চিন্তা প্রাধান্য পাচ্ছে। অনেকেই আন্দোলনের অংশগ্রহণের অজুহাতে বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। আইয়ুব খানের সময় হামুদুর রহমান কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কালাকানুন তৈরি করা হলে শিক্ষার্থীরা তার প্রতিবাদ করে। তখন একটি অগণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সরকার হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল করতে বাধ্য হয়। প্রতিটি সংকটকালে শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির স্বার্থরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতিকে তারা ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করেনি। আগে ছাত্ররা নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলন করত, রাজনীতি করত। কিন্তু এখন ছাত্ররাজনীতি কারও কারও কাছে বিত্ত-বৈভব অর্জনের সহজ পন্থা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে কমিশন ভোগ করা অনেকের জন্যই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিছু অর্থলোভীর কারণে ছাত্ররাজনীতি এখন আর আগের মতো শ্রদ্ধার স্থানে নেই।

রাজনৈতিক সরকারগুলো শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা সমাধানে কতটা আগ্রহী তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বরং রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনকে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এখনই সময় শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের। জাতীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং মানবিক বোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করা না গেলে আগামীতে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হব না। জনসংখ্যা যদি প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ হয়ে গড়ে উঠে, তাহলে তা দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হতে পারে। আর জনগণকে যদি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে দেশ অনেকটাই পিছিয়ে যাবে। কাজেই জাতীয় পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।

প্রফেসর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

শিক্ষা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম