গুজরাটে উচ্ছেদ অভিযান ও জাতীয় নিরাপত্তার অস্ত্রায়ন
কাওয়ালপ্রিত কাউর
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গুজরাটের চন্দোলা লেক এলাকায় একটি ভয়াবহ গণ-উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৮ হাজারেরও বেশি পরিবারকে আগে কোনো নোটিশ কিংবা বিকল্প পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই এক রাতে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়া ছবিগুলোয় দেখা যায়, রাজ্য কর্তৃপক্ষ বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর ভেঙে ফেলছে এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধরা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছেন। এই বাসিন্দারা তিন থেকে চার দশক ধরে এলাকায় বসবাস করছিলেন। অনেকের ভোটার আইডি কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড এবং অন্যান্য রাজ্য সরকার কর্তৃক ইস্যু করা বিভিন্ন কাগজপত্র ছিল, যা এ এলাকায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের বৈধতা প্রমাণ করে।
তবুও, এসব থাকা সত্ত্বেও, গুজরাট সরকার তাদের ‘বিদেশি নাগরিক’ কিংবা ‘রোহিঙ্গা’ বলে চিহ্নিত করেছে। এই একটি শব্দ, যা ভারতের রাজনৈতিক আলোচনায় মুসলিম অধিবাসীদের কলঙ্কিত করতে এবং উচ্ছেদ করতে ক্রমশ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি ভোটার আইডি কার্ড শুধু বাসস্থানের প্রমাণ নয়, এটি ভোটার তালিকায় দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্ভুক্তিও প্রমাণ, যা ভোট দেওয়ার আইনি অধিকারকেই প্রতিষ্ঠা করে। একইভাবে রেশন কার্ডগুলোও পুনর্বাসন নীতিতে বৈধ বাসস্থানের প্রমাণ হিসাবে গৃহীত হয়। মুশকিল হলো, প্রকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থী যারা, তাদের এ ধরনের পরিচয়পত্র থাকার কথা নয়। এ স্পষ্ট বিরোধিতা রাষ্ট্রের ফাঁপা দাবির স্বরূপই প্রকাশ করে, যা এ পরিবারগুলোকে গৃহহীন করতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। এই স্পষ্ট বৈপরীত্য রাষ্ট্রের দাবির অসারতা প্রকাশ করে, যা এই পরিবারগুলোকে গৃহহীন করে তুলতে তৎপর বলে মনে হচ্ছে।
ভারতে বুলডোজার রাজনীতির রূপরেখা
ভারতে বস্তি উচ্ছেদের ঘটনা নতুন নয়। তবে বর্তমানে যে পরিমাণে, যে মাত্রায় এবং দায়মুক্তির মাধ্যমে এগুলো করা হচ্ছে, তা আইনের কাঠামোগত দুর্বলতাকে আরও গভীরভাবে প্রতিফলিত করে। ভারতের সাংবিধানিক আদালত, যা একসময় সংখ্যালঘুদের রক্ষক হিসাবে বিবেচিত ছিল, এখন এ ধরনের কাজগুলোর প্রতি অন্ধ হয়ে রয়েছে। আরও খারাপভাবে বললে, এ ধরনের কাজে তারা বিচারিক বৈধতা দিচ্ছে।
ওলগা টেলিস, শান্তিস্টার বিল্ডার্স এবং চামেলি সিং-এর মতো পূর্ববর্তী আইনে, যারা ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে আশ্রয়ের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল-সেই থেকে আজ অধিবাসীদের শাস্তিমূলক ‘অবৈধ দখলকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করা গভীর উদ্বেগের বিষয়। এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো একসময় একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরত, যা বঞ্চিতদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করত। সেই সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি আজ ধ্বংসাবশেষের মতো পড়ে আছে।
আগে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল অধিবাসীদের কাগজপত্র যাচাই করা এবং তাদের দীর্ঘস্থায়ী বসবাস বিবেচনায় নিয়ে পুনর্বাসন সহজতর করা। এ দায়িত্ব, যা আইনি বিধান ও সাংবিধানিক নীতির সঙ্গে মিশে ছিল, তা এখন ক্রমেই উপেক্ষিত হচ্ছে। আজ ‘অবৈধ দখল উচ্ছেদের’ নামে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হচ্ছে। আদালতগুলো ক্রমেই একটি সংকীর্ণ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে, যা অধিবাসীদের শুধু জমির অবৈধ দখলকারী হিসাবে দেখায়। এ দৃষ্টিভঙ্গি তাদের অধিকারভিত্তিক সুরক্ষার বাইরে রেখে শহুরে পরিকল্পনার কাঠামোগত ত্রুটিগুলোকে আড়াল করে, যা এ ধরনের বসতি গড়ে ওঠার কারণ। এর ফলে রাষ্ট্রকে পুনর্বাসনের মানবিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
তার ওপর, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্যভিত্তিক উচ্ছেদে যন্ত্রপাতির ব্যবহার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ শাস্তিমূলক রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞের সূত্রপাত ঘটে ২০১৭ সালে, যখন আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন। ‘অপরাধের প্রতি শূন্য সহনশীলতা’ নীতির আওতায়, রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত উপায়ে, অধিকাংশ সময় বিচার ছাড়াই অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে উচ্ছেদের কৌশলের আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে এ কৌশল বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং ‘বুলডোজার ন্যায়বিচার’ নামে পরিচিতি পায়, যা মূলত ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে লক্ষ্য করে শাস্তির নামে তাদের বাড়ি, ব্যবসা ও জীবিকাকে উচ্ছেদের উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে এ প্রথা দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, যেখানে ভারতীয় রাষ্ট্র প্রকাশ্যে বুলডোজারকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে মুসলিম সম্প্রদায়কে দেশটিতে উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবহেলাকে আরও দৃঢ় করেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা প্রতিবাদ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধ্বংসযজ্ঞের লক্ষ্যভিত্তিক প্রকৃতি বিশেষভাবে স্পষ্ট করে, যেখানে রাষ্ট্র আগ্রাসক হিসাবে কাজ করে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অজুহাতে আবাসিক এলাকা ধ্বংস করে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বুলডোজারকে জনসমক্ষে মহিমায়িত করাও প্রমাণ করে, কীভাবে এই প্রথা ভারতের শাসনযন্ত্রে মিশে গেছে। বুলডোজারকে রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
গুজরাটের বিপজ্জনক নজির
গুজরাটের বর্তমান পরিস্থিতিকে নিবিড় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কীভাবে ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ নামে বা আড়ালে রাজ্যে এমন ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক মামলায় গুজরাট রাজ্য কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে অভিযোগ দাখিল করে বলেছে, ‘পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার’ পর পাওয়া ‘সংবেদনশীল তথ্যের’ ভিত্তিতে এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছিল। তারা আরও অভিযোগ করেছে, উচ্ছেদকৃত এলাকায় অবৈধ ‘বাংলাদেশি অভিবাসীদের’ বসবাস ছিল।
চলতি বছরের ২৯ এপ্রিলের এক আদেশে, প্রথম উচ্ছেদ অভিযানের পরপরই ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট হাইকোর্ট অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেন। যদিও আবেদনকারী চন্দোলা লেক এলাকার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বসবাস করে আসছেন। আপাতদৃষ্টিতে এ রুটিন আদেশ এবং উচ্ছেদ প্রক্রিয়া গভীর ও উদ্বেগজনক নজির স্থাপন করেছে। এটি বুলডোজার রাজনীতির একটি নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রা উন্মোচন করে, যেখানে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র অস্পষ্ট ও যাচাইবিহীন দাবি একটি পুরো সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত করার ভিত্তি হয়ে ওঠে। উচ্ছেদ অভিযান যখন জাতীয় নিরাপত্তার বাগাড়ম্বরে আচ্ছন্ন থাকে, তখন তা প্রতিটি মুসলিম এলাকাকে সন্দেহের জায়গায় রূপান্তরিত করার ঝুঁকি তৈরি করে এবং প্রতিটি বসতিকে রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
শেষ পর্যন্ত এটি সাংবিধানিক সুরক্ষার গুরুতর অবক্ষয়কে চিহ্নিত করে। হাজার হাজার বাড়ি ধ্বংস করা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের এমন স্বেচ্ছাচারমূলক নির্বিচার পদক্ষেপগুলোকে বৈধ শাসনব্যবস্থার অংশ হিসাবে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। আদালতকে অবশ্যই এ রাষ্ট্রীয় অবৈধ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে জীবন, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার অধিকার শিগ্গিরই এক বিলুপ্ত হতে চলা সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির অংশ হয়ে যাবে।
দি ওয়ার নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
কাওয়ালপ্রিত কাউর : দিল্লির আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী
