সচিবালয়ে অসন্তোষ ও অস্থিরতা
ড. মোহাম্মদ আব্দুস ছালাম
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে কয়েকদিন চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করেছে। কর্মচারীরা রাষ্ট্রের অন্যতম স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে লাগাতার আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের বিষয়বস্তু হলো, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর সাম্প্রতিক সংশোধনের মাধ্যমে নতুন ৩৭ক ধারা সংযোজন। নতুন সংযোজিত ওই ধারায় অনানুগত্য, কর্মে অননুমোদিত অনুপস্থিতি, কর্তব্য পালনে বাধাদানসহ মোট চার ধরনের অপরাধের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই অপরাধগুলোর জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারণ ও নিুপদ বা নিু বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণের বিধান রাখা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ওইরূপ সংশোধন মেনে না নিতে পারার কারণে সরকারি কর্মচারীরা কয়েকদিন আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করা দরকার।
একটু পেছনে ফিরে দেখলে দেখা যায়, সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধনের মাধ্যমে নতুন যে ৩৭ক ধারা সংযোজন করা হয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশের বিধানাবলির প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। তবে আগের অধ্যাদেশে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রথম কারণ দর্শানোর বিধান ছিল, যা বর্তমান অধ্যাদেশে সাত দিন। এছাড়া আগের অধ্যাদেশে ২য় কারণ দর্শানোর সময়সীমা ছিল তিন দিন, যা বর্তমান অধ্যাদেশে সাত দিন। অধিকন্তু, ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশে দণ্ডিত কর্মচারীকে আদালতের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, যা বর্তমান অধ্যাদেশে নেই। সুতরাং বর্তমান অধ্যাদেশের বিধানাবলি আগের অধ্যাদেশের তুলনায় অধিকতর নমনীয়।
সরকারি চাকরি আইনটি ২০১৮ সালে প্রণীত হলেও এটি কার্যকর হয় ১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখ থেকে। আইনটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৬টি আইন বাতিল হয়ে যায়, তন্মধ্যে সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ অন্যতম। বাকি ৫টি হলো-ক. সরকারি কর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪; খ. চাকরি (পুনর্গঠন ও শর্তাবলি) আইন, ১৯৭৫; গ. সরকারি চাকরিজীবীদের শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ, ১৯৮২; ঘ. সরকারি কর্মচারী (দণ্ড প্রাপ্তিতে বরখাস্ত) অধ্যাদেশ, ১৯৮৫; এবং ঙ. উদ্বৃত্ত সরকারি কর্মচারী আত্তীকরণ আইন, ২০১৬। বাতিলকৃত ৬টি আইনের মধ্যে ৪টির বিধানাবলি সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর বিধান পরবর্তীকালে সরকারি কর্মচারী (নিয়মিত উপস্থিতি) বিধিমালা, ২০১৯-এর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ বাতিল করা হলেও এর বিধানাবলি সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ বা অন্য কোনো আইন বা বিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটি সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর অন্যতম ত্রুটি। এছাড়া আইনটিতে আরও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি রয়েছে। যেমন: সরকারি চাকরিতে মেধা ও সততার লালনের কথা বলা হলেও তার বিকাশ বা এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত বিধান সন্নিবেশিত হয়নি। এছাড়া সৎ ও দক্ষ সরকারি চাকরিজীবীরা প্রায়ই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা বদলিসহ নানামুখী হয়রানির শিকার হন। এরূপ হয়রানি থেকে তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে আইনটিতে কোনো বিধান রাখা হয়নি। যেহেতু বর্তমান আলোচ্য বিষয় সেটি নয়, সেহেতু এ আলোচনা দীর্ঘায়িত করছি না।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮টি বহুদিন ধরে প্রচলিত। উল্লেখ্য, বিধিমালাটি পরিবর্তিত আকারে বেশ কয়েকবার নতুনভাবে প্রণীত হওয়ায় আগের বিধিমালাগুলো বাতিল হয়েছে। আলোচ্য অধ্যাদেশে বিধৃত সব শাস্তিই সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে। তবে বিধিমালায় বিধৃত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ; পক্ষান্তরে অধ্যাদেশটিতে তা সংক্ষিপ্ত। এছাড়া বিধিমালাটিতে ব্যক্তি পর্যায়ের অপরাধ, দণ্ড ও দণ্ড আরোপের প্রক্রিয়া বিধৃত হয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে অপরাধের ক্ষেত্রে সেখানে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সরকারি কর্মচারীদের অপরাধ বাস্তবে বিভিন্ন সময় পরিলক্ষিত হয়। তাহলে এর প্রতিকার কোথায়? আসলে বর্তমান অধ্যাদেশে সেই ঘাটতিটিই পূরণ করা হয়েছে মর্মে দেখা যায়।
ভবিষ্যতে আইনটির অপপ্রয়োগ হতে পারে-এ আশঙ্কায় আইনটির বিরোধিতা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি আইনের বিধান হয়রানিমূলক মর্মে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তা দীর্ঘদিন ধরে বহাল রয়েছে, কারণ সেগুলোর বাস্তব উপযোগিতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারা, যেখানে পুলিশকে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারাটির প্রচুর অপব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ ১২৬ বছর ধরে তা বহাল তবিয়তে রয়েছে। একইভাবে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ৩ ধারা, যেখানে বিনা বিচারে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখার বিধান রয়েছে, যা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি হিসাবে প্রতীয়মান হয়। ওই আইনগুলোর বিধানাবলি আপাতদৃষ্টিতে নিবর্তনমূলক মনে হলেও সমাজ ও দেশকে সুন্দর রাখার ক্ষেত্রে তাদের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হেতু দীর্ঘদিন ধরে সেগুলোকে বহাল রাখা হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯-এর বিধানগুলো দীর্ঘ ৪০ বছর বলবৎ ছিল। আইনটির অপব্যবহার খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। তাই তুলনামূলক কম কঠোর বিধান সংবলিত বর্তমান অধ্যাদেশটির ব্যাপারে আপত্তির যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। সময়, খরচ ও ভোগান্তি কমিয়ে জনগণের করের অর্থে পালিত সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন এটাই সাংবিধানিক দায়িত্ব। এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
ড. মোহাম্মদ আব্দুস ছালাম : সাবেক অতিরিক্ত সচিব
dpdbtpsp@gmail.com
