Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পরমাণুই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র নয়

Icon

সৈয়দা সানা বাতুল

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরমাণুই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র নয়

ছবি: সংগৃহীত

ভারত যখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে এবং পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুসের’ মাধ্যমে এর জবাব দেয়, তখন উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব প্রস্তুত হয়। বিশ্লেষকরা তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলেন। টুইটারে বিস্ফোরক সব তথ্য আসতে দেখা যায়। জাতীয়তার দুটি অসম্পূর্ণ কল্পনার মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখার সেই ক্ষতচিহ্ন আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন, এ মাসের শুরুতে যা ঘটেছিল, তা কেবল পরস্পর সামরিক শক্তির প্রকাশ ছিল, তাহলে কিন্তু আপনি আসল ঘটনাটি মিস করেছেন। হ্যাঁ, এটি যুদ্ধ ছিল, তবে কেবল ক্ষেপণাস্ত্রের নয়। এটি ছিল শিরোনাম, হ্যাশট্যাগ ও রাতের সংবাদকক্ষে সাজানো বর্ণনার যুদ্ধ।

আমরা যা দেখেছি, তা হলো পণ্ডিতদের বলা বিতর্কমূলক যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি-ভাষার মাধ্যমে পরিচয়, বৈধতা এবং ক্ষমতার ইচ্ছাকৃত নির্মাণ। ভারত ও পাকিস্তানের মিডিয়ার হাত দিয়ে প্রতিটি সহিংসতার স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হয়েছিল, প্রতিটি চিত্র তৈরি করা হয়েছিল, হতাহতের রাজনীতি করা হয়েছিল। এগুলো কাভারেজ ছিল না, ছিল নৃত্যনাট্য। ভারতীয় মিডিয়া একটি নৈতিক শক্তির জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করেছিল : একটি রাষ্ট্র, যা ক্রোধের পরিবর্তে সংযমের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানায়; শুধু ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নয়-ধর্ম, নৈতিক কর্তব্য এবং নৈতিক শৃঙ্খল দ্বারা সজ্জিত। শক্র পাকিস্তান নয়, বর্ণনায় জোর দেওয়া হয়েছিল-শত্রু ছিল সন্ত্রাস। আর কে এর বিরুদ্ধে আপত্তি তুলতে পারে? এটাই গঠনমূলক তত্ত্ব। গঠনমূলক তত্ত্ব বলে, রাষ্ট্রগুলো কেবল স্বার্থের ভিত্তিতে নয়, পরিচয়ের ভিত্তিতে কাজ করে। আর পরিচয় ভাষার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। ভারতের ক্ষেত্রে মিডিয়া এমন একটি গল্প তৈরি করেছিল, যেখানে সামরিক শক্তি নৈতিক স্পষ্টতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বলা হচ্ছিল, এই হামলাগুলো আগ্রাসন নয়, এগুলো আসলে মোচন। এগুলো যুদ্ধ ছিল না, এগুলো ছিল উপশম।

পাকিস্তানের মিডিয়াও এই বর্ণনাকে দেশভক্তির উৎসাহ দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছিল। ভারতের হামলায় মসজিদ ধ্বংস ও নিরীহ জনগণ নিহত, যা যুদ্ধাপরাধ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ধ্বংসস্তূপ ও রক্তের ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে শহীদ শব্দটি যুক্ত করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়, যা এই মুহূর্তে গড়ে উঠেছে, তা ছিল ন্যায়সঙ্গত পরিচয় : আমরা শান্তিপ্রিয়, কিন্তু উত্তেজিত; সংযত, কিন্তু দৃঢ়সঙ্কল্প। আমরা যুদ্ধ চাই না, তবে যুদ্ধের ভয়ও পাই না। এই মিল অদ্ভুত। উভয় রাষ্ট্রই নিজেদের রক্ষাকারী হিসাবে দেখেছিল, কখনো আগ্রাসী হিসাবে নয়। উভয়েই নৈতিক উৎকর্ষ দাবি করেছিল। উভয়েই বলেছিল, শত্রু প্রথমে গুলি চালিয়েছিল। উভয়েই বলেছিল, তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের কারখানা হিসাবে চিত্রিত করেছিল : দ্বিচারী, দুর্বৃত্ত, জিহাদে আসক্ত পারমাণবিক অস্ত্রধারী স্পয়লার। পাকিস্তানি পরিচয়কে তার সবচেয়ে খারাপ স্টেরিওটাইপ, প্রতারণামূলক ও বিপজ্জনক করে তুলেছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারতকে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে উপস্থাপন করেছিল। যে দেশটি একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের নেতৃত্বে অপমানে আচ্ছন্ন, ইতিহাস থেকে মুসলমানদের মুছে ফেলতে আগ্রহী। তাদের প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন আক্রমণকারী আর ভারত ছিল দখলদার। তাদের আক্রমণগুলোকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ হিসাবে নয়, বরং ধর্মীয় যুদ্ধ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শত্রু কেবল একটি হুমকি ছিল না, শত্রু ছিল একটি ধারণা এবং কোনো ধারণাই পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত নয়।

প্রতিদ্বন্দ্বী সত্যের ওপর নির্মিত বর্ণনাগুলো, যা যুদ্ধে সংবাদকক্ষে গড়ে উঠেছে, সমাবেশ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থাপিত হয়েছে, তা চিরস্থায়ী নয়। যেভাবে এগুলো নির্মিত হয়েছে, সেভাবেই ভেঙে ফেলা যেতে পারে। এবং সেটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা সবচেয়ে মেকি কণ্ঠস্বরকে না শুনে প্রকৃত কণ্ঠস্বরকে শোনার চেষ্টা করবো, যাকে আগে আমরা উপেক্ষা করে এসেছি। তাই পরেরবার যখন যুদ্ধের ঢোল বাজবে, শুধু প্রশ্ন করবেন-কে প্রথম গুলি চালিয়েছিল নয়, বরং কে শেষ কথা বলেছিল। এবং জিজ্ঞেস করবেন সেই ভাষণ কোন ঘটনা বলতে চেয়েছিল।

কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র পারমাণবিক নয়।

আল জাজিরা থেকে ভাবানুবাদ

সৈয়দা সানা বাতুল : যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম