জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ভিন্নমাত্রার বাংলাদেশ
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান (অব.)
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানবজাতি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আদি যুগে যে দ্বন্দ্ব মূলত খাদ্য এবং খাদ্যের উৎসসংশ্লিষ্ট ছিল, বর্তমান যুগে সেই দ্বন্দ্ব বহু রূপ, বহু আকার এবং বহু উৎস ঘিরে প্রকাশিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতার চরম বিপর্যয় মানবজাতির অবিমৃশ্যকারিতা ও হঠকারিতার পরিচায়ক। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বিগত ৭৫ বছরে ৭১টি শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনা করেছে, যাতে ২০ লক্ষাধিক শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমান সময়ে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে ১১টি শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। ১৯৮০ সাল থেকে চলমান ইরান-ইরাক যুদ্ধ জাতিসংঘের দূতিয়ালিতে ১৯৮৮ সালে যুদ্ধবিরতি হয়। ওই বছর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উদ্যোগে ১৫ সেনা কর্মকর্তার ইউনাইটেড নেশন্স ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ, সংক্ষেপে UNIMOG-এ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের অবদান রাখা শুরু হয়। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তি সহায়তা এবং শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ জনবলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে এযাবৎ বাংলাদেশ ৪৩ দেশে ৬৩টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছে এবং ২ লাখ ৫৫৮ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছে। এ নিবন্ধ লেখার সময়ে ১১টি জাতিসংঘ মিশনে ৫ হাজার ৮১৮ জন শান্তিরক্ষী কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে আছে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীও পেশাদারত্ব, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে দায়িত্ব পালন করে। কিছু ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও সার্বিকভাবে বিগত ৩৭ বছরে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সব ধরনের বিপদ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন এলাকার জনগণের অভাবনীয় ভালোবাসা ও প্রশংসা অর্জন করেছে এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছে। এ ভালোবাসা আর আস্থা অর্জনটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পর ওই দেশের জনগণ ২০০২ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ভাষাকে সম্মাননীয় অফিশিয়াল ভাষা হিসাবে ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশের এ সফলতা অর্জনের পেছনে উৎস শক্তি হচ্ছে দেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি, সংবিধান এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা। বাংলাদেশের বৈশ্বিক শান্তির প্রতি জাতীয় প্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস হলো গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে জাতি গণহত্যা, নিপীড়ন, বাস্তুচ্যুতি, নির্যাতন ও মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষকে একটি বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আরও গভীরভাবে অনুধাবনের সক্ষমতা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ‘সংঘাতের সংস্কৃতির চেয়ে সহযোগিতার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে’, বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। এ চেতনা প্রত্যেক শান্তিরক্ষীর মাঝে সঞ্চারিত হয়েছে।
আরেকটি প্রধান প্রেরণার উৎস হলো সাংবিধানিক দায়িত্ব। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার শপথ বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিফলিত নীতিমালার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে : ‘যাতে আমরা স্বাধীনতার পথে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারি এবং মানবজাতির অগ্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য পূর্ণ অবদান রাখতে পারি।’ সংবিধানে ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ২৫-এ আন্তর্জাতিক বিরোধের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহারের কথা বিবৃত আছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি শান্তিরক্ষী বাহিনী এ প্রেরণা শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকা; এ দায়িত্বটি তারা সম্পাদন করে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় নিরস্ত্র জনগণের প্রতিরক্ষা প্রদান, জরুরি চিকিৎসা প্রদান, অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ ও মানবিক সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে। কিছু ক্ষেত্রে সামরিক পর্যবেক্ষক এবং শান্তিরক্ষী দল স্বউদ্যোগে দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী কম্বোডিয়া, বসনিয়া, লাইবেরিয়া, কঙ্গো, নামিবিয়া, সিয়েরালিওন ইত্যাদি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মানবতার সেবায় অসামান্য অবদান রেখেছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করি। আমি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত আইভরি কোস্টে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে আইভরি কোস্টের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে শিশুদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করে। আমার অধীনস্থ ব্যাটালিয়ন কর্তৃক নিজ উদ্যোগে ব্যাটালিয়ন সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রামে শিশুদের জন্য ‘পাঠশালা’ নামে একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৩২ জন শিক্ষার্থী-১৭ জন ছেলে এবং ১৫ জন মেয়ে-শিক্ষার সুযোগ পায়। আমাদের লক্ষ্য ছিল শিশুদের স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া মান শহরে একটি অনাথ আশ্রমে নিয়মিত চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। এ পদক্ষেপগুলো সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিপর্যস্ত মানুষের হৃদয় ও মন জয় করার কার্যকর পথ। এতে স্থিতিশীলতা ও শান্তিরক্ষা করা সহজতর হয়।
আমরা নিজেদের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত রেখেছিলাম, যা আইভরি কোস্টে টেকসই শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক ছিল। মেডিকেল ক্যাম্পেইন, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি, শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম, পানি বিতরণ, বৃক্ষরোপণ, সবজির বাগান তৈরি, স্থানীয় আইভরিয়ানদের সঙ্গে ফুটবল, ম্যারাথন ও বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার মতো ক্রীড়া অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি-এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা সব পক্ষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম হই। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মানবিক আচরণ প্রভূত প্রশংসিত হয়। এ উদ্যোগগুলো যুদ্ধবিপর্যস্ত নাগরিকদের মধ্যে আশার আলো জাগায়; বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা ও ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়।
বাংলাদেশের উচিত একটি সমন্বিত শান্তিরক্ষা কৌশল (holistic peacekeeping strategy) প্রণয়ন করা এবং জাতিসংঘকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব করা যে, কোনো সংকট বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপে-সংঘর্ষ থেকে স্থিতিশীলতা, স্থিতিশীলতা থেকে শান্তি এবং শান্তি থেকে সমৃদ্ধির পথে-টেকসই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এভাবেই আমরা ভবিষ্যতের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আরও কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারি এবং বিশ্বের সামনে একটি রোল মডেল হিসাবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারি।
নীল হেলমেট পরা জাতীয় গর্বের একটি বিষয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান, এনডিসি, পিএসসি (অব.) : লেখক, গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
