অন্যমত
প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বাজেট
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা আজ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এমনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটা ৫ আগস্টের আগে হয়তো কেউ বুঝতে পারেনি। যতই দিন যাচ্ছে, সবার কাছে অর্থনীতির রক্তক্ষরণের বিষয়টি ততই পরিষ্কার হচ্ছে। এ বিষয়টি সামনে রেখে সরকারকে এখন একটা বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বাজেট যদি আরও বড় হতো, তাহলে উন্নয়ন বাজেট আরও কিছু নেওয়া যেত। কিন্তু তাতে করের বোঝা বাড়ত অথবা ঘাটতি বাজেট বিশাল আকার ধারণ করত। এই যে ঘাটতি বাজেটে বর্তমানে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করছে, তা হচ্ছে অতীতের ঘাটতিকে পূরণ করার জন্য। কারণ, সুদ তো দিতে হবে। সে জন্য এ সরকারের একটা ভালো সিদ্ধান্ত যে, আমরা বিশাল আকারের বাজেটের দিকে গিয়ে ঘাটতি বাজেট আর বাড়াতে চাই না। কারণ আয় থেকে খরচ যতই বাড়ানো হবে ততই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে। প্রশ্ন হলো কী কী ইঙ্গিত আসছে এ বাজেটে? বাজেট ঘাটতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। মুদ্রাস্ফীতি কমছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে। এ কারণে আমরা অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছি। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যথেষ্ট করছে বাংলাদেশের জন্য। তাদেরকে স্যালুট।
এবারের বাজেটের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর সংগ্রহ। কর সংগ্রহ নির্ভর করে জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর। কারণ বিনিয়োগ বেশি হলে ভোগ বেশি হবে। ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বস্তুত বিনিয়োগ ও ভোগের সঙ্গে জড়িত। অর্থনীতি নিম্নমুখী হওয়ায় কর সংগ্রহ কম হয়েছে। ইচ্ছা করলেই কর সংগ্রহ রাতারাতি বাড়ানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে গড় কর হার বেশি। কেউ বলতে পারবে না যে, আমরা প্রতিযোগিতামূলক কর অবস্থায় আছি। ভিয়েতনামে আমাদের থেকে কম, এমনকি ভারত করপোরেট আয়কর অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কর হার বাড়লে কর সংগ্রহ বেশি হবে-এ ধারণা ঠিক নয়। বরং কর হার বাড়ালে অনেকে পথ খুঁজবে কর কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায়। সে কোনো আয়ই দেখাল না; তাহলে কী হবে? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের ব্যয়ের ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে অনেক বরাদ্দ আছে, সেখানে সরকারের অনেক টাকা-পয়সা নষ্ট হচ্ছে। দুর্নীতিতে খেয়ে ফেলেছে সব। শিক্ষা খাতে অপব্যয় হচ্ছে। শিক্ষক যেখানে ১০ জন দরকার, সেখানে আছে ১৫ জন। সরকারের আকার বাড়ছেই বাংলাদেশে। মোট যে বাজেট প্রণয়ন করি, তার ৭০ শতাংশ রাজস্ব বাজেট। এর কারণ হলো, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় বিশাল আকারের সরকার নিয়ে আমরা বসে আছি। এখন এ বিশাল আকারের সরকারকে চালাতে হলে জনগণকে কর দিতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে দেশের অর্থনীতিকেও দক্ষ মাত্রায় আনা যাবে না। আমাদের থেকে অনেক বড় অর্থনীতির দেশ অথচ সরকারের পরিধি অনেক ছোট, এমন অনেক দেশ আছে। তারা কীভাবে পারছে? তারা পারলে আমরা কেন পারব না?
রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো কর হারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে কর হারের আওতায় আনতে হবে। মফস্বল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে। অটোমেশনে যেতে হবে। একেকজনের ঢাকা শহরের বাড়ি ৪-৫টি, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম বহু আছে। ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না। কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়েন। এগুলো দেখা উচিত।
কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। রাতারাতি হয়তো এর বেশি আশা করা যায় না। তবে পরিবর্তন আসছে, অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে দেখছি না। সরকারের পরিধি বা আয়তনটা ছোট করতে পারলে, সেটা সবচেয়ে বড় কাজ হবে। কিন্তু আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে সরকারের আকার ছোট করা যাবে না। আমরা অর্থনীতি পড়ানোর সময় এভাবে বলি যে একটা লোক পুরোপুরি কাজে নিয়োজিত-এটা বুঝব কী করে? ধরা যাক, সে পূর্ণ সক্ষমতায় আট ঘণ্টা কাজ করে। এখন আমি যদি বলি, এখানে ছয়জন আছে। ওই ছয়জন থেকে একজনকে বাদ দিয়ে যদি বলা হয়, আপনারা পাঁচজন কি ওই একজনের কাজও করবেন? করলে আপনাদের টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে সবাই রাজি হয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, পাঁচজনের জায়গায় ছয়জন কাজ করছে। সুতরাং সরকারের আকার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবেই।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক শিল্প একসময় সচল ছিল ১০-১৫ বছর আগে, এখন কাজ করে না। এগুলো সরকার রাখছে কেন? বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এত লোকসান গোনার পরও আমরা সরকারি খাত কেন রাখছি? ভারত এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করে দিয়েছে। পাকিস্তান পিআইএ বিক্রি করে দিয়েছে। তাহলে ভর্তুকি দিয়ে আমরা কেন রাখছি? বর্তমান সরকার এগুলোকে বেসরকারিকরণ করার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছে। একটা কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কী মানে আছে। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া-সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি কেন একটি লোকসানি শিল্পকে, যেটা দিয়ে কিছু হবে না সেটাকে কেন সরকারের মধ্যে রেখে দিয়েছি? আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতো না পারব কিছু ক্ষেত্র ছাড়া, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যাই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে এবং বেশিই হচ্ছে।
আমরা আশা করছি, যে বাজেট অর্থ উপদেষ্টা মহোদয় উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন, সেখানে শেয়ারবাজার নিয়ে ভালো কথাবার্তা থাকবে। ভালো প্রণোদনার কথা থাকবে আশা করছি। সরকারকে ৮০ শতাংশ করপোরেট আয়কর দেয় তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো। সরকারের উচিত হবে বেশি বেশি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা। এ ব্যাপারে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সহসাই একটা ফল পাব। বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছে। পুঁজিবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা, কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা, কেউ হিসাব গোপন করে কিনা, হিসাব বিবরণী মান বজায় রাখে কিনা-এগুলো যাচাই করাই ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ফলাফল পেতে একটু সময় নেবে। আমরা সেই ফলাফল পাওয়ার প্রত্যাশায় রইলাম।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ
