Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শহীদ জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি এবং প্রাসঙ্গিকতা

Icon

ড. একেএম মতিনুর রহমান

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শহীদ জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি এবং প্রাসঙ্গিকতা

শহীদ জিয়াউর রহমান

বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম। জিয়াকে মানুষ প্রথম জানতে পারে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’র মাধ্যমে। সেসময় এক সামরিক কর্মকর্তার কণ্ঠ পুরো জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণে। স্বাধীনতার পর শহীদ জিয়ার উত্তরণ ঘটে কালজয়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে।

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এ কথা আজ স্বীকার করতেই হবে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব মহান ব্যক্তিত্ব স্মরণীয় হয়ে আছেন, শহীদ জিয়া তাদের অন্যতম।

শহীদ জিয়া হতাশায় নিমজ্জিত জাতিকে আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি বহুধাবিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, দেশকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা প্রণয়ন করেন।

১৯ দফা কর্মসূচিগুলো হলো : ১. সর্বতোভাবে স্বাধীনতা, অখগুতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা। ৩. সর্ব উপায়ে নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে, তার ব্যবস্থা করা। ৭. দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে, তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১০. দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা। ১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্ধুদ্ধ করা। ১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশগঠনের মনোবৃত্তিকে উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা। ১৬. সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন এবং উন্নয়নব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ১৮. দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করা।

১৯ দফা কেন মাইলফলক : ভূ-রাজনৈতিক কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তার স্বাধীনতা, অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে প্রথম দফায় তার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের সমর্থন, সহযোগিতা এবং আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন জরুরি ছিল।

নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীদের শিক্ষিত করে জাতি গঠনের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে যথাযোগ্য মর্যাদা সুনিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য বেসরকারি খাত ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান করেন।

তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা : এছাড়া তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরিজীবীদের আর্থিক সচ্ছলতা আনা এবং প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসাবে নিয়োজিত থেকে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেন।

প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ : প্রশাসনিক সেবা ও উন্নয়ন জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ : বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও শাসনতন্ত্রে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় সংহতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী সব জাতিসত্তা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ দর্শনে পরিচিত করে তোলেন।

তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন, মাটি আর মানুষই হলো দেশ। জাতীয় অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন শহর-গ্রামাঞ্চলের সুষম উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা, বিশেষ করে কৃষিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে গতিশীল করার চিন্তাভাবনা, খালখনন ও বয়স্ক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন, একশ বছর পর বাংলাদেশ অগ্রগতির কোনো স্তরে উপনীত হবে; রোগ-ব্যাধি-শিক্ষা-কুসংস্কার দারিদ্র্যের ওপর বাংলাদেশ কতটুকু বিজয় অর্জন করবে এবং শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নতির স্পর্শ কতটুকু লাভ করবে-এ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনীতিক এতটুকুও ভাবেননি। জিয়াউর রহমানের চিন্তাভাবনা এ প্রেক্ষাপটে ছিল ঐতিহাসিক ও বাস্তবসম্মত। শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং সামগ্রিক দিক থেকে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ রেখে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করলে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি সফলতার সঙ্গে সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ইন্দো-সোভিয়েতবলয় থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পূর্ব এশিয়ায় চীনের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেন। ইঙ্গ-মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সংশ্লিষ্ট করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তৈরি পোশাকশিল্প প্রবেশ করিয়ে এবং রেমিট্যান্স উপার্জনে মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে কার্যকর উদ্যোগ নেন। তিনি অনুভব করেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতা বিস্তৃত না হলে জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হবে। তাই ভারত ও পাকিস্তান যে ক্ষেত্রে চুপচাপ থেকেছে, সেক্ষেত্রে জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অগ্রসর হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে।

শহীদ জিয়া কখনো সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে, এমনকি পারিবারিক স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি বরং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং জনগণের স্বার্থই ছিল মুখ্য ভূমিকায়। এটি তার শ্রেষ্ঠ অবদান, যা আজও বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে শহীদ জিয়ার ১৯ দফা, খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ এবং বিএনপির ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা সমন্বয় করে তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশকে সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসাবে গড়ে তোলাই হবে আজকের অঙ্গীকার।

ড. একেএম মতিনুর রহমান : প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; সাবেক সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

akmrahman1971@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম