Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা সমাজ দেশ

সমাধান হতে পারে জাতীয় সরকার

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমাধান হতে পারে জাতীয় সরকার

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান সমাজে মুখের কথার সঙ্গে কাজের মিল দেখা পাওয়া বিরল ব্যাপার। প্রতিদিনের পত্রিকা এসব কথাই বলে। এ অবক্ষয়ের কি পরিবর্তন করা সম্ভব? অবশ্যই; তবে সময়সাপেক্ষ। সমাজের এসব সাইকোলোজিক্যাল বিষয়গুলোর গুরুত্ব কি সংস্কারকরা আদৌ দেবেন? মনে হয় না। সংস্কার ভালো-মন্দ মিলে কিছু একটা হবে। কিন্তু দেশ কি ভালো হয়ে যাবে? বিশ্বাস করা কঠিন। এদেশের রাজনীতিকরাই তো দেশ চালাবেন। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, স্বার্থবাদিতা, দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া-সব তো এখনই দেখছি। নির্বাচন হলেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে যাবে, বিশ্বাস করি না। রাজনৈতিক শক্তি দলবদ্ধ। দেশের তুলনায় দলের নেতাকর্মীদের সুবিধা নিয়ে তারা ব্যস্ত। রাজনৈতিক দল হলেই যে দেশপ্রেমী হতে হবে, এমন কথাও তো নেই। ৫৪ বছর ধরেই তো এদেশ সরেজমিন সবকিছুই প্রত্যক্ষ করল। মন-মানসিকতার সুস্থ পরিবর্তন হলে দেশ গড়ার কাজে সুযোগ দিতে পারেন, আবার নিজেরাও ভালো কাজে অংশ নিতে পারেন। তাতে দেশ উপকৃত হয়। তাদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।

তবে দেশ বাঁচাতে ও গড়তে শুরু তো করতেই হবে! স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একবার এবং ’২৪-এ আরেকবার বড় রকমের সুযোগ এলো; এরপরও যদি আমাদের বিবেকবোধ না জাগে, তাহলে ভবিষ্যতে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কথায় বলে : ‘যা হলো না বিয়ের রাতি, তা হবে আবার আশ্বিন-কার্তিক?’ অবশ্য ‘হাজার কষেতে ঘোল না হয় মাখন’-এ কথাও সত্য। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের সময় বিএনপি ঘোষণা করেছিল, নির্বাচনে জিতলে দেশে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করবে-কথাটা আজও মনে আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আদর্শে, অর্থাৎ জাতীয়বাদী চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দফাভিত্তিক উন্নয়ন, দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মী দমন ও ভারতীয় শোষণমুক্ত রাজনীতির মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করতে হবে, নইলে দলে আজ হোক আর কাল হোক বিপর্যয় আসবে। প্রয়োজনে ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত নিরাপত্তা বলয় চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে। কারণ ইতিহাস বলে, উগ্র হিন্দত্ববাদী আধিপত্যবাদ কোনো দিনই আমাদের ভালো চোখে দেখবে না।

‘জাতীয় সরকার কেন দরকার? এর জবাব হবে অনেক বড়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় : ভারতীয় সরকার এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর বর্তমানে বড় হুমকি। তাদের দাস দলবলসহ তাদের ঘরে গিয়ে বসে আছে। তারা এদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল দাসের মাধ্যমে দেশটা লুটে খেতে; উপমহাদেশে তাদের ক্ষমতার দাপট বাড়বে, এই আশা নিয়ে। তারা ধরে নিয়েছিল যে এদেশের অনেক তথাকথিত প্রগতিবাদী ইসলামবিদ্বেষী হয়ে তাদের পক্ষে কাজ করবে। বিধাতা তাদের সব আশা পূর্ণ করেছিলেন। এদেশকে বাণিজ্যিক পশ্চাৎভূমি হিসাবে ব্যবহার করার পুরো সুবিধাটাই তারা পাবে। দেশটা করদরাজ্যে পরিণত হবে। হয়েছিলও তাই। দীর্ঘ ৫৪টা বছর আমরা তাই দেখলাম, মাঝে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাড়ে তিন বছর বাদে। ‘যদি বলি পেয়েছি যা তার আদৌ কিছু চাইনি, চেয়েছি যা নিজের করে, পাইনি-কিছুই তার পাইনি।’ জীবন থেকে যে ৫৪টা বছর পেরিয়ে এক পা কবরে চলে গেল, এর কী হবে? সুতরাং দেশের যে বর্তমান সংঘাতময় অবস্থা, পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যে দা-কুমড়া সম্পর্ক; রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তর ভাগে যে নিয়ন্ত্রণহীন অনৈতিকতা ও মেরে-কেটে খাওয়ার মানসিকতা; সামাজিক মূল্যবোধের যে অবর্ণনীয় অবক্ষয়-সবকিছুই বলে, শুধু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ যথেষ্ট নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ চালানোর জন্য ‘জাতীয় সরকার’ এ মুহূর্তে অগ্রগণ্য। পলাতক আসামিদের ও লুটের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। লুটপাট করা সব অবৈধ টাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনরঞ্জনে, প্রভাবশালী দলীয় লোকজন কিনতে এবং দেশের অস্থিতিশীলতার কাজে ব্যয়িত হচ্ছে ও অনেক দিন ধরে ব্যয়িত হবে। এ কারণে অন্তত ২০-৩০টি প্রয়োজনীয় দফার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে একমত হয়ে জাতীয় সরকার গঠন সময়ের দাবি। এতে আপনাআপনি একজনের দোষ অন্যের দিয়ে শুধরানো হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। ভালো কাজের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। দল পুষ্ট না হয়ে দেশ পরিপুষ্ট হবে। বিগত ১৫ বছরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার সমাপ্ত করতে এবং সংস্কার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে ও যথাসম্ভব বাস্তবায়ন করতে ‘জাতীয় সরকার’ ব্যবস্থার বিকল্প নেই।

কীভাবে কার্যকর সম্ভব? প্রথমেই শাসনব্যবস্থার ধরন পরিবর্তন করতে হবে। দেশে প্রেসিডেন্ট-শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। ছোট্ট একটা দেশ, কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। কমপক্ষে প্রথম মেয়াদের জন্য অরাজনৈতিক কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাক্রমে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও অবদান বিবেচনা করে নির্বাচনের জন্য এমপি মনোনয়ন দেবেন। নির্বাচনের পর এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠিত হয়ে যাবে। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্বে সংসদ এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে করতে হবে। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রেসিডেন্ট করবেন। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাছাই করা অরাজনৈতিক পেশাজীবীদের মধ্য থেকে উচ্চমানের নির্বাচকমণ্ডলীর প্রত্যক্ষ ভোটে ১৫ থেকে ২১ সদস্যবিশিষ্ট অরাজনৈতিক একটি ‘জাতীয় কাউন্সিল’ বা ‘সুপ্রিম কাউন্সিল’ গঠন ও এজন্য নির্বাচন করতে হবে। তাদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ বা বিশেষ ক্ষেত্রে ২/৩ সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিতে প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। প্রেসিডেন্টের নিজের হাতেও কিছু কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে। নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা হতে পারে ২ থেকে ৩ লাখ। এ ক্ষেত্রে পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষের আর প্রয়োজন হবে না। এতটুকু দেশে সংসদ-সদস্যের সংখ্যা ক্রমশ বাড়াতে গেলে সরকারি খরচ যেমন অনেক বেড়ে যাবে, তেমনই ক্রমে ক্রমে প্রতি ইউনিয়ন থেকে এমপি নির্বাচিত করার প্রস্তাবও অমূলক মনে হবে না। রাজনীতিতে আবার বেশি বেশি টাকার খেলা শুরু হবে। এমপি পদের মর্যাদা ক্রমেই ক্ষুণ্ন হবে। রাজনীতিতে অবৈধ টাকার খেলা যত কমবে, সুশিক্ষিত-সৎলোক তত দেশ সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতিতে আসবে।

এদেশের মানুষ প্রজেক্টভিত্তিক কাগজ-কলমের পরিকল্পনার কাজ আর বেশি দেখতে চায় না। তারা চায়, প্রতিটা সংস্কার, বিধিবিধানের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন হোক।

ড. হাসনান আহমেদ : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ

pathorekhahasnan.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম