ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গেল সোমবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এবং তার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছেন। তাকে অভিনন্দন। যদিও বিগত অনেক বছরের স্বৈরাচারী ও একগুঁয়েমি শাসন বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের অনেক চাওয়া রয়েছে; কিন্তু দেশের রাজস্ব আয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্যপ্রাপ্তি বিবেচনায় বড় বাজেট করার সংগতি ছিল না। অতীতের ব্যাপক অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দুর্বলতাও এখানে প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৮ হাজার কোটি টাকা কম। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এডিপি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সংকোচনমূলক বাজেট।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক অনুদান থেকে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ১২.২ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে জনপ্রশাসনে ৩১ লাখ ৬ হাজার ২১৮ কোটি টাকা (বাজেটের ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ) স্থানীয় ও পল্লী উন্নয়নে ৪৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা (বাজেটের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ), প্রতিরক্ষায় ৪০ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা (বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ), জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৩৩ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা (বাজেটের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ), শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ১১ লাখ ৬৫৮ কোটি টাকা (বাজেটের ১৪ শতাংশ), স্বাস্থ্যে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা (বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৪৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা (বাজেটের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ), গৃহায়নে ৫ হাজার ১১০ কোটি (বাজেটের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ), বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্মে ৬ হাজার ৫৪০ কোটি (বাজেটের শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ), জ্বালানি ও বিদ্যুতে ২২ হাজার ৫২০ কোটি (বাজেটের ২ দশমিক ৯ শতাংশ), কৃষিতে ৪৬ হাজার ২৬৮ কোটি (বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ), শিল্প ও অর্থনীতি সেবায় ৪ হাজার ২৭২ কোটি (বাজেটের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ) এবং পরিবহণ ও যোগাযোগে ৭১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা (বাজেটের ৯ শতাংশ) প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে বেতন, ভাতা ও ভর্তুকির মতো খরচ চলতি অর্থবছরের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজেট ঘাটতি অতীতের মতোই জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে।
আমরা অর্থ উপদেষ্টাকে বলতে শুনেছি, ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বাজেটের আকার ছোট করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
আগামী অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ও ঋণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে উল্লেখ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা ধরার কথা জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
আলোচনা হয়েছে ও রয়েছে-রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা আর সম্ভাবনা বিবেচনায় আরও ছোট বাজেট হতে পারত। অনেকে বলছেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। কেউবা জোর দিয়েছেন সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী আরও বিস্তৃত করার জন্য। হয়তো তাদের দাবি যৌক্তিক, কিন্তু ইতিহাস বলে অতীতে এর সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি আর অপচয়ের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের বরাদ্দের অর্থও ব্যবহার করতে পারছে না। উদ্বৃত্ত কৃষি বিবেচনায় কৃষিক্ষেত্রেও আমাদের বাজেটের দিকে নতুন করে নজর দিতে হবে। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য গবেষণায় নতুন করে জোর দেওয়ার কথা নাই-বা বললাম।
আমদের স্থানীয় বা বিদেশি দুই সূত্র থেকেই আয় কম। অন্যদিকে আমরা আবার গুণগত ও কাঙ্ক্ষিত মান বজায় রেখে ব্যয় করতেও পারছি না। অতীতে দেখা গেছে, বাজেট নিয়ে সংসদে যেমন খুবই কম আলোচনা হয়েছে, তেমনই বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নেও ছিল না প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। সুশাসনের দারিদ্র্য আমাদের পিছু ছাড়ছে না।
মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
