Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আরাফাত : অনুতাপের কান্নায় ভেজা মুক্তির দিন

Icon

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আরাফাত : অনুতাপের কান্নায় ভেজা মুক্তির দিন

ফাইল ছবি

কিছু কিছু দিন আছে যখন আসমান যেন আরও নিচে নেমে আসে। বাতাস হয়ে ওঠে ভারী-আশা আর অনুশোচনায়। এমন এক অবিনাশী দিনের নাম ‘আরাফাত’। কেবল একটি দিন নয়, এটি মুমিন হৃদয়ের জন্য এক আধ্যাত্মিক জাগরণ, হৃদয় আর প্রভুর মাঝে পর্দাহীন সংলাপের এক মোহময় আয়োজন।

আরাফাত আসে হৃদয়কে গলিয়ে দিতে, পাপভারে নুয়ে পড়া চোখ দুটোকে কান্নায় হালকা করে দিতে। এদিন বান্দা আল্লাহর দরজায় এমনভাবে ফিরে আসে, যেন সে কখনো ফিরেইনি এত কাছাকাছি। বুকে জমে থাকা বহু বছরের অনুতাপ যেন এ দিনে গলে পড়ে, মাটিতে মিশে যায় মাফের বৃষ্টিতে।

এই দিনেই পূর্ণতা পেয়েছিল ইসলাম। ইতিহাসের গভীরতম মুহূর্তে, আরাফাতের প্রান্তরে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছিলেন সেই আয়াত, যা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম।’ (সুরা আল-মায়েদা, আয়াত ৩)

এটি কোনো সাধারণ বার্তা ছিল না। এটি ছিল এক চূড়ান্ত আলোকবর্তিকা, যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জীবনে নেমে আসে পথের দৃশ্যমানতা। একে ঘিরেই গড়ে ওঠে আত্মার মুক্তির কাঠামো।

আরাফাতের দিন হলো সেই দিন, যেদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমা করেন। ফেরেশতারা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে, যেখানে লাখ লাখ হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে প্রভুর দরবারে পড়ে আছে। নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহতায়ালা আরাফাতের দিন সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এবং তিনি ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন-তোমরা দেখ, আমার বান্দারা এলোমেলো চুলে, ধূলিমাখা হয়ে এসেছে আমার কাছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৪৮)

সেই দৃশ্য কল্পনা করুন-যেখানে পবিত্র আরাফাতের মাঠ জুড়ে কান্না, দোয়া আর তাওবার ছায়া। একবুক পাপ নিয়ে বান্দারা দাঁড়িয়ে, আর আসমান খুলে যাচ্ছে অনুগ্রহের দরজা দিয়ে।

আরাফাতের দিনে রোজা রাখার যে ফজিলত, তা এক অলৌকিক আশীর্বাদ। রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘আশা করি, আল্লাহ আরাফাতের দিনের রোজার বিনিময়ে পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)

একটি মাত্র দিন, অথচ বিনিময়ে পুরো দুই বছরের পাপমোচনের প্রতিশ্রুতি! একদিনের ক্ষুধা, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয়। এ দিনটি এমন একটি দরজা, যা মুমিনের জন্য চিরকাল খোলা থাকে, তবে সে যদি বোঝে। এই দিন, যেখানে একটি চোখের পানিই হয়ে ওঠে চাবিকাঠি, একটি ‘আল্লাহুম্মাগ ফিরলি’ হয়ে যায় মুক্তির সেতু। দোয়ার এমন একটি সময়, যখন আকাশের দরজাগুলো থাকে উন্মুক্ত এবং বান্দার নিঃশব্দ মিনতি ফিরে যায় না।

নবীজি (সা.) এ দিনটির দোয়ার মর্যাদা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সর্বোত্তম দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৮৫)। তাই এ দিনে বান্দা কাঁদে, চায়, ডাকে। হৃদয় খোলে, পাপ ঝরে, আত্মা নরম হয়। কী অপার সৌন্দর্য এই দিনের! কোনো অলংকার লাগে না দোয়ার। শুধু একটি অনুতপ্ত হৃদয়ই যথেষ্ট।

আরাফাত আমাদের বলে, তুমি যত গোনাহ কর না কেন, ফেরার পথ এখনো খোলা। যতদিন এ দিনকে অনুভব করতে পর, ততদিন মুক্তির আশা হারাবে না। এ দিন আত্মাকে শুদ্ধ করার দিন, পাপকে পেছনে ফেলে দেওয়ার দিন। এ দিন এক জীবন্ত সাক্ষ্য, যে মাফ এখনো সম্ভব, ক্ষমা এখনো আসে, করুণা এখনো ঝরে পড়ে।

আসুন, এ আরাফাতে আমরা ফিরি। পৃথিবীর সব গর্জন পেছনে ফেলে একবার দাঁড়াই সেই করুণাময়ের সামনে। হৃদয়ের আরাফাত তৈরি করি, যেখানে প্রভুর জন্য রাখা থাকবে কান্না, ভালোবাসা আর লজ্জা। যেখানে আমরা নিজেকে দিই, আর বিনিময়ে পাই শান্তি, পাই মুক্তি।

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান : প্রাবন্ধিক

mdraiæan6790@+gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম