Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

মনের পশুকেও জবাই করতে হবে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মনের পশুকেও জবাই করতে হবে

আর একদিন পরেই বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালিত হবে। মুসলমানদের দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ধর্মীয় উৎসব হলেও এ উৎসবগুলোর আমেজ থেকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বঞ্চিত করা হয় না। সব ধর্মেই বছরের কোনো না কোনো সময়ে এক বা একাধিক দিনে উৎসব পালনের রেওয়াজ রয়েছে। খ্রিষ্টান ধর্মে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনটি পালিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। খ্রিষ্টজগতে বড়দিনকে কেন্দ্র করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এই উৎসবটিকে করে তুলেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল বেথেলহেমের গোয়াল ঘরে ঘাস বিচালির মধ্যে। সেই যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন বার্লিনের পাঁচতারকা হোটেলে মহা উৎসবের মধ্যে পালিত হতে দেখে প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী এক বিশাল বৈপরীত্য লক্ষ করেছিলেন। একইভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মেও বেশকিছু ধর্মীয় উৎসব রয়েছে।

ইসলাম শুধু প্রার্থনার ধর্মই নয়, এতে রয়েছে উৎসবের আনন্দ। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা যতটা প্রার্থনার, ততটাই আনন্দ-উৎসবের। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে খুশির ঈদুল ফিতর। এই ঈদুল ফিতর নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের একটি অমর গান রয়েছে। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলেই আমাদের বেতার ও সম্প্রচার মাধ্যমে বেজে ওঠে নজরুলের গানের কলি-ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। এই ঈদে সাধ্যমতো নতুন কাপড় পরে পূতপবিত্র হয়ে ঈদের জামায়াতে শামিল হওয়া এ উৎসব দিনের নির্দিষ্ট প্রার্থনা। এরপর একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে মুসলমানরা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রকাশ ঘটায়। এই ঈদের প্রধান আকর্ষণ মিষ্টি, পায়েস দিয়ে আপ্যায়নে অংশগ্রহণ। বিশ্ববাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় এখন বাংলাদেশের ঈদের উৎসবে আরবের খেজুর দিয়েও আপ্যায়নকে ইসলামি সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ঈদুল ফিতরের আপ্যায়ন থেকে প্রতিবেশী বা বন্ধুস্থানীয় অন্য ধর্মের লোকরাও বঞ্চিত হয় না। ঈদুল ফিতরের অন্যতম ধর্মীয় বিধান হচ্ছে ফিতরা দেওয়া। ফিতরার এই নিয়ম দরিদ্রদের ঈদের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ দেয়। ইসলাম দরিদ্রজনের জন্য আন্তরিকতা বোধের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

ঈদুল আজহা আসে ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দের আমেজ নিয়ে। এই ঈদে হালাল পশু কুরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে ইব্রাহিমের (আ.) আমল থেকে। ইসমাইল (আ.) ছিলেন ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রাণপ্রিয় পুত্র। আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে নির্দেশ করলেন, তাঁর রাহে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানি দিতে। ইব্রাহিম (আ.) গভীরভাবে ভেবেচিন্তে দেখলেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হলেন ইসমাইল (আ.)। তাঁকেই কুরবানি করতে হবে। ইব্রাহিম (আ.) বিষয়টি তাঁর প্রিয় পুত্রের কাছে খুলে বললেন। ইসমাইল (আ.) বিন্দুমাত্র আপত্তি করলেন না, ভীতও হলেন না। তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করাই শ্রেষ্ঠত্বের দরজা। নির্দিষ্ট দিনে পিতাপুত্র কুরবানিস্থলে উপস্থিত হলেন। ইব্রাহিম (আ.) নিজ প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালিয়ে দেখলেন ইসমাইল (আ.) অক্ষত রয়েছেন। সে জায়গায় একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে আছে। আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ঈমান পরীক্ষা করেছিলেন মাত্র, অন্য কিছু নয়। দুজনেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই ইসলামের নবী। সেই থেকে ঈদুল আজহার দিনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হালাল পশু কুরবানি দেওয়ার রেওয়াজ চলে এসেছে। বিশ্ব মুসলিমজগতে এই দিনে কুরবানি দিয়ে এবং কুরবানির পশুর গোশত নিজেদের মধ্যকার দুর্বল ও দরিদ্রদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার যে ত্যাগের আদর্শ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে অনাগত দিনগুলোয়।

কুরবানির মধ্য দিয়ে আমরা মুসলমানরা পশু কুরবানি দিই। এই কুরবানি একটি প্রতীক মাত্র। এর আসল শিক্ষা মনের পশুকে কুরবানি দেওয়া। মানব মন অত্যন্ত দুর্বল। এই মনে অনেক সময় নিষিদ্ধ কাজকেও আকর্ষণীয় মনে হয়। এর ফলে মানুষ পাপের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়। মানুষকে তাই চেষ্টা করতে হয় রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত থাকতে। রিপুর তাড়নাই হলো মনের পশু। এই তাড়নাকে জয় করতে পারলে মানুষ সত্যিকার অর্থে আশরাফুল মখলুকাত হয়ে উঠবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই। ঈদুল আজহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো মনের পশুকে জবাই করা। মানুষ যখন পশুবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়, তখন সে এক ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়। সেই মানুষই পারে এই মর্তলোক স্বর্গের সুবাতাস দিয়ে ভরে তুলতে।

জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে পর্যন্ত ঈদুল আজহার কুরবানি দেখে আসছি। আব্বা বেশির ভাগ সময় অংশীদারদের নিয়ে গরু কুরবানি করতেন। নিজেই গরু কেনার জন্য অংশীদারদের নিয়ে গরুর হাটে যেতেন। সেসময় গরুর হাট বসা নিয়ে বা হাটের ইজারা নিয়ে বড় ধরনের কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে বলে শুনিনি। আমার যখন শৈশব, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৮০ শতাংশ কিংবা তারও বেশিসংখ্যক মানুষ ছিল দরিদ্র-হতদরিদ্র। কুরবানির নিয়ম অনুযায়ী, কুরবানির গোশতের একটি অংশ গরিবদের হক। গরিব আত্মীয় হলে এই হক আরও শক্ত। কুরবানির পশু জবাই করার পর কাটাকুটি করে অংশীদারদের মধ্যে নিক্তির ওজনে ভাগ করা হতো। তারপর ভাগীদাররা গোশতের নিজ অংশ নিজ বাড়িতে নিয়ে যেত। এরপর গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণের পালা। তখন গরিব মিসকিন ও ভিক্ষুকদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তাদের এক-দুই টুকরার বেশি গোশত দেওয়া সম্ভব হতো না। একদিকে কুরবানি দেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়, অন্যদিকে গরিব মিসকিনদের সংখ্যা ছিল এর বহুগুণ। এ কারণে এদের মুখে হাসি ফোটানো সহজসাধ্য ছিল না। ঘর-সংসার করার পর নিজে যখন কুরবানি দেওয়া শুরু করলাম, তখন থেকে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করল। তবে ১৯৭৫-এর আগে নয়। এর আগে ১৯৭৪-এ দেশে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে। এই দুর্ভিক্ষে ৩৫ লাখ আদম সন্তান প্রাণ হারিয়েছেন। সেই সময় আমাদের মতো নিুমধ্যবিত্তদের পক্ষে দৈনন্দিন ভাতের জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। অজস্র মধ্যবিত্ত পরিবার ভাতের পরিবর্তে গমের রুটিতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা অতি ধীরে হলেও কিছুটা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে। এখন কুরবানির গোশত বিতরণ করার জন্য গরিব-মিসকিনকে তুলনামূলকভাবে অনেক কমই পাওয়া যায়। এখন শুক্রবার দিন নিয়মিতভাবে ভিক্ষুকদের দরজায় কড়া নাড়তে দেখা যায় না। তারপরও কিছু পেশাদর ভিক্ষুক রয়েছে, যাদের চৌরাস্তার সংযোগস্থলে দেখা যায়। তাদের দাবি, এখন কমপক্ষে ১০ টাকা। আমি শৈশবে ভিক্ষুকদের ১ ফুটো পয়সা ভিক্ষা গ্রহণ করতে দেখেছি। এখন কুরবানির গোশত তুলনামূলকভাবে গরিব আত্মীয়স্বজন এবং অধস্তন কর্মচারীদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ আর্থার লুইস বলেছেন, যদি দেখা যায়, কোনো দেশে গৃহস্থালির কাজ করার জন্য পরিচারক-পরিচারিকা পেতে কষ্ট হয়, তখন বুঝতে হবে দেশটির অর্থনীতি উন্নয়নের পথ ধরে এগোচ্ছে। শত দুর্নীতি, শত প্রকারের লুণ্ঠন ও শোষণ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে কিছু এগিয়েছে, তার প্রমাণ কুরবানির গোশতে বিতরণের চেহারায় পরিবর্তন।

বাংলাদেশে এক দশক আগেও কুরবানির জন্য গরুর প্রচণ্ড অভাব ছিল। ওই সময় ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গরু পালন ও গরু মোটাতাজাকরণ ব্যাপকতা অর্জন করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গরুর খামার গড়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা ছাগলেল চাষও সম্প্রসারিত হয়েছে। সব মিলে দেশ এখন কুরবানির গরুর চাহিদা মেটাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খামারিদের দাবি, ভারত থেকে যেন গরু চোরাচালান না হয়ে আসে। গো-খাদ্যের সমস্যা এখনো রয়েছে। তবে গো-খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কারখানার সংখ্যা বাড়লে এই সমস্যা থাকবে না। অভিযোগ আছে, অনেক খামারি গরুকে স্টেরওয়েডজাতীয় ওষুধ খাইয়ে কিংবা ইঞ্জেকশন দিয়ে মোটাতাজা করে। এ ধরনের গরুর গোশত মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, এভাবে মোটাতাজা করা গরু নির্দিষ্ট সময়ের পর হঠাৎ মারা যায়। খামারিরা এখন আগের তুলনায় সচেতন। তারা গরুগুলোকে স্বাভাবিক খাদ্য দিয়ে পুষ্ট করার চেষ্টা করছে। এদের ব্যবসাভিত্তিক গরুর খামারগুলো প্রধানত ঈদুল আজহাকে লক্ষ করে পরিচালনা করা হয়। কাক্সিক্ষত দামে গরু বিক্রয় না হলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুরবানির হাটে গরু নিয়ে আসার জন্য তাদের পরিবহণ খরচসহ অনেক ধরনের খরচ বহন করতে হয়। এমন খরচ করার পরেও গরু বিক্রয় করতে না পারলে মাথায় হাত পড়ে।

বড় বড় শহরে গরুর হাট ইজারা দেওয়া হয়। ইজারাপ্রত্যাশীদের মধ্যে মস্তানির প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। এর ফলে যারা বাহুবলে কম দামে ইজারা নেয়, তারা স্থানীয় সরকারগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারণ, হাটের ইজারা থেকে স্থানীয় সরকারের ভালো অঙ্কের আয় হতে পারে। ইজারাদাররা গরু বিক্রেতাদের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটারিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্তভাবে সৃষ্টি করে না। ফলে বিক্রেতাদের কষ্টের শিকার হতে হয়। তবুও বিক্রেতা ও বিক্রয়কর্মীরা ৫-৬ দিন ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট করে অপেক্ষা করে তাদের পশুর ন্যায্য দামের জন্য। ঈদুল আজহায় গরিবের একটি বড় হক হলো কুরবানির পশুর চামড়া। কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে গরুর চামড়ার দাম প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। আসলে এই দেশে গরিব ও ক্ষমতাহীন মানুষের মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। জানি না কবে এই দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম