লস অ্যাঞ্জেলেসে যা ঘটছে তা দখলদারত্ব
আহমদ ইবসাইস
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
লস অ্যাঞ্জেলেসে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো প্রত্যেক মার্কিনির জন্য সতর্কবার্তা, যারা সংবিধানগত শাসনব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করে। কোনো বিদ্রোহ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিক্রিয়ায় নয়, বরং অভিবাসন আইন প্রয়োগকারী অভিযানের বিরুদ্ধে হওয়া বিক্ষোভ দমনে এখানে ফেডারেল সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো লস অ্যাঞ্জেলেস শহরকে ‘অবৈধ সমাবেশ এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিপজ্জনকও বটে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্তম্ভগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
গেল ৬ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে যা শুরু হয়েছিল, তা দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নেয়। ফেডারেল এজেন্টরা লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিযান চালিয়ে রেস্তোরাঁ, দোকান ও অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে ১২১ জনকে আটক করে। প্রকাশ্য দিবালোকে চালানো এ অভিযান ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টির পরিকল্পিত কৌশল।
এর প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত। বিকাল নাগাদ বিক্ষোভকারীরা দাঙ্গাবাজ হিসাবে নয়, বরং শোকাহত গোষ্ঠী হিসাবে শহরের কেন্দ্রস্থলে জড়ো হয়েছিল। স্লোগানের পাশাপাশি তাদের প্ল্যাকার্ডে শোভা পাচ্ছিল, ‘এদের মুক্তি দাও!’ এটি ছিল শোকের প্রকাশ, রাগের কণ্ঠস্বর। কিন্তু আজ আমেরিকায় শান্তিপূর্ণ শোক ও রাগের প্রকাশও অনুমোদিত নয়, যখন তা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যায়। পুলিশ জোরপূর্বক ব্যবস্থা হিসাবে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে, বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে ফ্ল্যাশ-ব্যাং গ্রেনেডের। প্রতিবাদকারীরা সহিংস পথে না হাঁটলেও একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভকে সরকারি বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ উত্তেজনাকে আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি একটি স্মারকলিপি স্বাক্ষর করেছেন, যার ফলে লস অ্যাঞ্জেলেসে ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে এবং প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলে এখানে মেরিন সেনাও মোতায়েন করা হতে পারে।
এসব কর্মকাণ্ডের আইনগত বৈধতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিক্ষোভ দমন আইন অনুসারে, ফেডারেল বাহিনী কেবল তখনই মোতায়েন করা যায়, যখন একটি গণঘোষণা দ্বারা নাগরিকদের ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এখানে এমন কোনো ঘোষণা করা হয়নি। ট্রাম্প এ আইন অনুসরণ করেননি। এমনকি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিয়ুসম, যিনি রাজ্যের নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তার সঙ্গে পর্যন্ত কোনো পরামর্শ করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা হচ্ছে, তাকে শুধু অবহিত করা হয়েছে। এ বিদ্রোহ যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের জন্য হুমকি নয়, লস অ্যাঞ্জেলেসে কোনো শত্রু যোদ্ধা নেই, এখানে রয়েছে শুধু ক্ষুব্ধ ও শোকগ্রস্ত কিছু মানুষ, যারা তাদের সম্প্রদায়ের মর্যাদা দাবি করছে। আমরা যা দেখছি তা ফেডারেল কর্তৃপক্ষের আইনগত কার্যকারিতা নয়, বরং আইনের আড়ালে করা এক ধরনের শক্তিপ্রয়োগ, ধীরে ধীরে সাংবিধানিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করা, যা ট্রাম্পের অনৈতিক ঘোষণা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে করা হয়েছে। আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে এই সেনা মোতায়েনকে সম্ভবত অবৈধ বলে গণ্য করা হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, এটিই এ সংকটের সবচেয়ে শীতল দিক। আমরা দ্রুত এমন এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে কাগজপত্রসহ বা ছাড়াই পেশিশক্তি এসেছে এবং আইন কেবল একটি মুখোশ, এখানে বৈধ কিংবা অবৈধ বিষয়টি আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এ মুহূর্তটি আলাদা করে বোঝানো সম্ভব নয়। উপনিবেশবাদের বিশ্লেষণে পণ্ডিত আইমে সিজেরের মত অনুযায়ী, প্রান্তিক অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতা অবশ্যম্ভাবীভাবে মূলকেন্দ্রে ফিরে আসে। বিদেশে তৈরি দমনমূলক কার্যকলাপও এক সময় নিজ দেশেই চলে আসে। আমেরিকায় এটি কয়েক দশক ধরে চলা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৯৬ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স অথোরাইজেশন অ্যাক্টের একটি ধারা পেন্টাগনকে স্থানীয় পুলিশ বিভাগের কাছে অতিরিক্ত সামরিক মানের অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দেয়। পরবর্তী তিন দশকে বিদেশে সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার জন্য ব্যবহৃত একই অস্ত্র দরিদ্র ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মোতায়েনের জন্য পুলিশ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হলে ভিনদেশি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ করে দমনের কৌশল হিসাবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আনা হয়। কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রে প্যাট্রিয়ট আইন এবং বিদেশি গোয়েন্দা নজরদারি আইনের মতো ব্যাপক আইন পাস করে, যা দেশটিতে ব্যাপক নজরদারি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকে সক্ষম করে তোলে। যখন আমেরিকার বাইরে সরকার গুয়ানতানামো বে-তে অপহরণ, নির্যাতন ও অবৈধ হেফাজতের অভিযান চালাচ্ছিল, তখন দেশে ‘সন্দেহভাজন’ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আইনগত যুদ্ধ চালানো হচ্ছিল।
আইনি কাঠামোর চেয়ে এখানে যা ঘটছে, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেল এজেন্টরা যখন হোম ডিপো স্টোরের বাইরে প্রতিবাদকারীদের ওপর ফ্ল্যাশ-ব্যাং গ্রেনেড ছুঁড়ছে, যখন আইসিই সদস্যরা মেয়রদের বিরুদ্ধে ‘অরাজকতা ও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের’ পক্ষে থাকার অভিযোগ করছে, যখন এফবিআই কর্মকর্তারা পাথর ছোঁড়ার কারণে আসামিদের ধরার খবর এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছে-তখন আমরা এমন এক বর্ণনার নির্মাণ দেখছি, যা রাষ্ট্রের এ সহিংসতাকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলে। যদি এই দৃষ্টান্ত স্থায়ী হয়, তাহলে ফেডারেল সেনারা প্রতিরোধের জন্য স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠবে। যারা প্রেসিডেন্টকে ভোট দেবে না, এমন শহরগুলো দখলের জন্য প্রস্তুত হবে। প্রতিবাদকে বিদ্রোহ হিসাবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হবে। পরের বার যখন মানুষ ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় জমায়েত হবে, তখন তাদের সামনে পুলিশ নয়, সৈন্য থাকবে।
যখন একজন প্রেসিডেন্ট আইন মেনে চলা ছাড়াই সৈন্য মোতায়েন করতে পারে এবং কেউ তাকে থামায় না, তখন আইন তার ক্ষমতা হারায়।
এ সময়ে আমাদের শুধু আইনি চ্যালেঞ্জ নয়, নৈতিক স্পষ্টতাও প্রয়োজন। লস অ্যাঞ্জেলেসে যা ঘটছে, তা আইন প্রয়োগ নয়, এটা দখলদারত্ব। যা বিদ্রোহ হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছে, আসলে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। যা জনসুরক্ষা হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা আসলে রাজনৈতিকভাবে ভয় দেখানো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঠিক এই মুহূর্তের জন্য অবকাঠামো তৈরি করছে। যদি আমরা এই মুহূর্তটির আসল রূপ না চিনতে পারি, তাহলে আমরা এমন এক দেশে বেড়ে উঠব, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের সামরিক শক্তি রাজনীতির প্রধান ভাষা হয়ে থাকবে।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তরিত
আহমদ ইবসাইস : প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি আমেরিকান
