অনুভূতির সার্বভৌমত্ব
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান (অব.)
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
৫ আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশের জনগণ সর্বশেষ তাদের অনুভূতির সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করে। ২০১৮-এর রাতের ভোট এবং ২০২৪-এর ডামি নির্বাচন সেই সার্বভৌমত্বটি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথা এ নির্বাচন পদ্ধতিই কেবল নয়, সাধারণ মানুষের কথা বলার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের মাধ্যমে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, জননিরাপত্তা আইন ২০০০, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮ ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে যে কোনো বিষয়ে মন্তব্য, আলোচনা বা সমালোচনা কিংবা ভিন্নমত পোষণ করার দ্বার রুদ্ধ করা হয়। বিভিন্নভাবে ভীতির সঞ্চার করা হয়। জীবনহানি, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া, পেশাগত ক্ষেত্রে অপদস্ত হওয়া, ব্যবসায়িক ক্ষতি-রাজনীতিক, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, আইনজীবী বা পেশাজীবী কেউই এসব ভীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। সহজ ভাষায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে জনগণের অনুভূতির সার্বভৌমত্বটি কেড়ে নেওয়া হয়। কেবল ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮-এর আওতায় প্রথম তিন বছরে সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৪৬৫৭টি মামলা করা হয়।
উপর্যুক্ত আইন প্রয়োগ করে, এমনকি আইনের তোয়াক্কা না করে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে বিনাবিচারে তাদের দিনের পর দিন বন্দি রাখা হয়, বেশকিছু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ৬২৯ জন গুমের শিকার হন বলে জানা গেছে; যাদের মধ্যে ৪১৯ জনের এখনো হদিস মেলেনি। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুমের সংখ্যাটি ৭৫৮ বলে উল্লেখিত হয়েছে। এ অপরাধ কর্মগুলোর সঙ্গে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, ডিজিএফআই, এনএসআই এবং এনটিএমসি জড়িত বলে গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জনগণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে অনুভূতির সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়। গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণ প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর, বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসের ওপর অগাধ আস্থা স্থাপন করেছিল। ২০২৪-এর লড়াই কেবল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল না, এটি ছিল জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই।
দেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথমে শাসনতন্ত্র, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত ছয়টি কমিশন গঠন করে। পরবর্তীকালে এ কমিশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১। ১৫ জানুয়ারি ২০২৫-এ শাসনতন্ত্র, নির্বাচন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত চারটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ইতোমধ্যে আরও কিছু কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আর কোনো কোনো কমিশন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন পেশ করেছে।
জনগণের অনুভূতির দালিলিকীকরণে কমিশনগুলোর ব্যর্থতা আছে। চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী কিংবা খুলনা, কোথাও কমিশন গিয়েছে এবং জনগণের বক্তব্য শুনেছে এমন তথ্য জানা নেই। আঁতেল সমাজ যেমন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি রাজনৈতিক দল শতভাগ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অনুশীলনের অনুপস্থিতি সর্বজনবিদিত। কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নের আগে উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্য কর্মী সভার আয়োজন করেছে বলে জানা যায়নি। একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকের বক্তব্য-‘সাধারণ মানুষ কি সংস্কার বোঝে?’ একথা জনগণের অনুভূতির প্রতি চরম অবহেলার পরিচায়ক। বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনুভূতির সার্বভৌমত্ব উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
অন্তর্জালে কলমযোদ্ধারা যেমন অতিমাত্রায় সক্রিয়, তেমনই রাজনীতির মাঠে সংশ্লিষ্ট দল ও গোষ্ঠীগুলো পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। বাড়ির ছোট সন্তানের জন্য মায়ের যেমন বেশি স্নেহ প্রকাশিত হয়, তেমনই রাজনীতির মাঠে নবাগত একটি দলের জন্য সরকারের অতিরিক্ত স্নেহ কারও নজর এড়ায় না। নির্বাচন অনুষ্ঠান করার আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার কিংবা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সরকারের শ্লথগতি ভাবনার অবকাশ তৈরি করে বৈকি। যে আস্থা ও বিশ্বাস জনগণ অন্তর্বতীকালীন সরকারের ওপর স্থাপন করেছিল, তাতে চিড় না ধরলেও সেই আস্থা ও বিশ্বাস মলিন হয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না; যার প্রতিফলন দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার বিষয়ে জনগণের নির্লিপ্ততায়।
এরই মধ্যে রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে নতুন একটি সংস্কৃতি ‘মব সংস্কৃতি’র উদয় হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ়তার অভাবে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও দল ‘মব’ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করছে। কিছু ক্ষেত্রে নবাগত দলটির জন্য সরকারের পক্ষপাতিত্ব লক্ষণীয়। আবার অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের আচরণ সম্পূর্ণই বিপরীত। এ প্রেক্ষাপটে জনগণের আস্থায় যে অচিরেই চিড় ধরবে না, সেটি বোঝার জন্য তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকার যদি জনগণের অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আরেকটি গণজাগরণ হয়তো অনিবার্য হয়ে পড়বে।
জনগণ যেন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ভীতিহীন নির্বাচনে তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে তার ইচ্ছার প্রতিফলনের মাধ্যমে। কিন্তু সেই আয়োজনে সরকারের দ্বিধা ও অস্পষ্টতা ব্যাখ্যাতীত। এটি সবার মনে রাখা দরকার, জনগণের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ সত্য উপলব্ধির একমাত্র পথ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান, এনডিসি, পিএসসি (অব.) : লেখক, গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
