বর্জ্যও হতে পারে সমৃদ্ধির উৎস
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। আর সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে বাহকবাহিত নানা রোগ। এসব রোগের একটি উৎস হলো বর্জ্য। ঢাকায় বিপুল পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদিত হয়। রাজধানীকে পরিপাটি রাখতে এ বিশাল বর্জ্য পদার্থের অপসারণ কতটা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬,৫০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। একই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রায় ৫৫ শতাংশ বর্জ্য প্রতিদিন অপসারণের বাইরে থেকে যায়; যা যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। অতিষ্ঠ করে তুলেছে নগরজীবনকে। দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে চলেছে মশা-মাছিবাহিত রোগ-জীবাণু। কেড়ে নিচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। অর্থ খোয়াচ্ছেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা। একবার যদি একটু সুস্থ মাথায় চিন্তা করি, প্রতিদিনের ৫৫ শতাংশ বর্জ্য যদি স্তূপীকৃত হতেই থাকে, তাহলে পুরো শহর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হতে কত সময় আর বাকি। ঢাকা শহরের কোনো রাস্তায় একজন মানুষ স্রেফ ৫ মিনিটের জন্য নাকে হাত বা অন্য কিছু দিয়ে না ঢেকে উন্মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন না। এমনই বেহাল। কিছু কিছু স্থান আছে এমন, নির্মল বায়ু তো দূরের কথা, জানালা দিয়ে বাতাস এলে দুর্গন্ধে ঘরে থাকা যায় না। উদাহরণ হিসাবে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের পশ্চিম দিকের যে খালটি রয়েছে, তার কথা একবার ভাবুন। খালের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাস যখন পাশের বাসায় প্রবেশ করে, তখন কি বাসিন্দারা শান্তি বা স্বস্তিতে থাকতে পারে? ২০১৬ সালে ঢাকা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১১ হাজার ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল নগরবাসী দূষণ কমাতে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলবে। এখন ডাস্টবিনগুলোর অস্তিত্ব নেই। একইভাবে গুলশান এলাকায় ১০০টি স্মার্ট ডাস্টবিন এখন পুরোপুরি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
সলিড ওয়েস্টেজ বা কঠিন বর্জ্য মাটি ও পানি দূষণেরও অন্যতম কারণ। দূষণকারী বর্জ্যরে মধ্যে হাসপাতালের এবং বৈদ্যুতিক বর্জ্য আরও মারাত্মক। সরকারি হাসপাতালের চারদিকে এর প্রতিফলন লক্ষণীয়। এমন একটি নাজুক অবস্থার শহরে যখন বিভিন্ন উৎসব উদ্যাপিত হয়, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে আসে। তাই উৎসবগুলো শুরুর আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। আবার এখন চলছে বর্ষাকাল। এ বর্ষাকালেই মারাত্মক ভেকটরবাহিত রোগ, যেমন ডেঙ্গুর ভয়াল রূপ দেখা যায়।
প্রতিদিন বর্জ্য অপসারণের কাজে যেসব যানবাহন ব্যবহৃত হয় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মীর দিকে লক্ষ রাখা অতি জরুরি। ময়লাভর্তি খোলা যানবাহন যে রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করে তা পুরো রাস্তায় ময়লা নিঃসৃত পানি মারাত্মকভাবে দূষিত করে জনজীবন ও পথচারীদের অতিষ্ঠ করে তোলে। মারাত্মকভাবে দূষিত করে বায়ুমণ্ডলকে। একইভাবে যে ল্যান্ডফিলগুলোতে এ আবর্জনা ফেলা হয়, তা-ও খোলা থাকে, যার ফলে আমিনবাজার ও মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে জনজীবন ও পথচারীর জীবন অত্যন্ত নির্মম অবস্থায় পড়ে গেছে। আবার অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরে অনেক বাড়ির অপ্রবেশ্য গলির মধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কিছুতেই প্রবেশ করতে পারে না। তাই ওই স্থানগুলো যেমন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, তেমনি পরিণত হয়েছে মশা উৎপাদনের কারখানায়। আমরা জানি, বর্জ্য পদার্থ ব্যাকটেরিয়াসহ অসংখ্য অগণিত অনুজীব বসবাস করে; যা অনেক রোগজীবাণুর উৎস হিসাবে কাজ করে। তাহলে ভাবুন, প্রতিদিন স্তূপীকৃত ৫৫ শতাংশ বর্জ্য পদার্থ নিত্যদিন কী পরিমাণ রোগ ছড়াচ্ছে।
এখন প্রশ্ন, এ অসম্ভব নাজুক অবস্থানের উত্তরণ কোথায়। কীভাবে এ মারাত্মক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
এবার বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরিতে কিছু রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। বর্জ্য পদার্থ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব দেশ শীর্ষস্থানীয়, তার মধ্যে চীন ১,১৮,৬৪৫ মেগাওয়াট, যুক্তরাষ্ট্র ৭১,৭১৪ মেগাওয়াট, জার্মানি ৫৭,২০০ মেগাওয়াট, যুক্তরাজ্য ৪১.৭৯৪ মেগাওয়াট এবং ভারত ৪৫,৭৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিবছর উৎপাদন করে থাকে। আমাদের দেশেও এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে মেগা শহরগুলোতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তা অবশ্যই আশার আলো দেখাবে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৬,৫০০ টন বর্জ্য এবং ১২টি মেগা শহর বা সিটি করপোরেশনে প্রায় ১৭,০০০ টন বর্জ্যকে ইনসিনেরেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রায় ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিদিন উৎপাদন সম্ভব। একইভাবে ম্যানহোলের ময়লাও পরিণত হতে পারে খাঁটি স্বর্ণে। ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব ৩০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ নালা (ড্রেনেজ) এবং ৮৮০ কিলোমিটার পয়োনালার ওপর ম্যানহোল রয়েছে ৪১ হাজার। দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পাইপ নালার ওপর রয়েছে ৩৩ হাজার ৩৩৩টি ম্যানহোল। এছাড়া বিভিন্ন কলোনিতে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব কিছু ম্যানহোল রয়েছে। ম্যানহোলের বর্জ্যও হতে পারে বায়ো ফার্টিলাইজারের মূল উৎস। এমনকি এসব রপ্তানি করে বাংলাদেশ পেতে পারে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা।
এখনই সময়, যথার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা শহরকে একটি নান্দনিক শহরে রূপান্তরিত করে মূল অর্থনীতিতে স্থায়ী ভূমিকা রাখার। মশা-মাছি বা অন্যান্য বাহকবাহিত রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া সম্ভব নয়। মানবসৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ রোগজীবাণুর আধার না হয়ে হতে পারে অর্থনৈতিক সাশ্রয় ও সমৃদ্ধির একটি গতিশীল ব্যবস্থা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে ক্রমাগত খুইয়ে যাওয়া পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা উপহার দিতে পারব একটি স্বাস্থ্যসম্মত নান্দনিক বাংলাদেশ।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
