নিউইয়র্কের চিঠি
ইমিগ্র্যান্টদের শান্তিতে থাকতে দেবেন না ট্রাম্প
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইমিগ্র্যান্টবিরোধী অভিযানের প্রতিবাদে প্রথমে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সবচেয়ে জনবহুল স্টেট ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস সিটিতে। দুদিনের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে ২১টি অঙ্গরাজ্যের কমপক্ষে ৩৭টি শহরে। হাজার হাজার ইমিগ্র্যান্ট ও তাদের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই সেন্ট্রাল আমেরিকান ও এশিয়ান দেশগুলোর বলে গণমাধ্যম খবর দিয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চড়াও হয়, যানবাহন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করে। লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো কোনো শহরে ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের মোতায়েন করে। অনেক স্থানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর, সারা দেশে সহস্রাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে কেবল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই আটক করা হয়েছে চার শতাধিক ইমিগ্র্যান্ট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে। নিউইয়র্ক সিটিতে গ্রেফতার করা হয়েছে ১১৫ জনকে। আগামী দিনে আরও বিক্ষোভ হতে পারে বলে আশঙ্কা করলেও প্রশাসন প্রতিবাদের মুখে তাদের অবৈধ ইমিগ্র্যান্টবিরোধী অভিযান থেকে পিছু হটবে, এমন ধারণা করার কারণ নেই। এ ধরনের অভিযান চলমান প্রক্রিয়া। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোরতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যতদিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন, ততদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত ইমিগ্র্যান্টরা যে শান্তিতে থাকতে পারবেন না, তা প্রায় নিশ্চিত। অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের বহিষ্কার করতে তিনি নতুন নতুন ফন্দিফিকির করতে সিদ্ধহস্ত। ইমিগ্র্যান্ট বিতাড়নে তিনি তার প্রথম মেয়াদের চেয়েও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ হচ্ছে, যেসব অবৈধ ইমিগ্র্যান্টের ওপর আগে থেকেই বহিষ্কারাদেশ ছিল, তারা সেই আদেশ লঙ্ঘন করে যুক্তরাষ্ট্রে রয়ে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ। জরিমানার পরিমাণ যে কারও মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো। ইমিগ্রেশন আদালত কোনো বিদেশির ওপর চূড়ান্ত বহিষ্কারাদেশ জারি করার পর তারা যত দীর্ঘসময়ই যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে কাটান না কেন, অবৈধ অবস্থানের শেষ পাঁচ বছরকে হিসাবে নিয়ে প্রতিদিনের জন্য মাথাপিছু গুনতে হবে ৯৯৮ ডলার করে। ইতোমধ্যে বহিষ্কারাদেশ লঙ্ঘনকারী ৪,৫০০ অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট শনাক্ত করেছে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ (আইসিই), যাদের কারও কারও ওপর সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ডলার জরিমানা পরিশোধের জন্য নোটিশ জারি করা হয়েছে। তাদের ওপর ধার্যকৃত মোট জরিমানা ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। কোনো বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট অবৈধভাবে বসবাসের জন্য জরিমানার নোটিশ পেয়েছেন কি না, জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টদের সতর্ক করেছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা যাতে ছোটখাটো আইনভঙ্গের কোনো কারণ না ঘটান। কারণ, তুচ্ছ ঘটনাকেও অজুহাত হিসাবে নিয়ে অনেকের বৈধ ইমিগ্র্যান্ট স্ট্যাটাসও বাতিল করার ঘটনা ঘটছে। এর পাশাপাশি অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের নমনীয় একটি সুযোগের ঘোষণাও দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, যা হলো অবৈধদের কেউ যদি স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তাদের দেশে ফেরার বিমান ভাড়া ছাড়াও নগদ এক হাজার ডলার করে প্রদান করা হবে। প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ প্রশাসন কর্তৃক কাউকে বহিষ্কার করার ব্যয়ের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। অবৈধ কোনো ইমিগ্র্যান্টকে গ্রেফতার, ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখা এবং বিমানে সংশ্লিষ্টের দেশে ফেরত পাঠানোর গড় ব্যয় বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার ডলার। তবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তাদের ‘প্রজেক্ট হোমকামিং’ নামে এ উদ্যোগের সাফল্যের ব্যাপারে তেমন আশাবাদী নয়। গত এপ্রিলে ঘোষিত কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে ২০ মে পর্যন্ত মাত্র ৬৪ জন অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন। এর আগে ২০০৮ সালে একই ধরনের প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়ার পর মাত্র আটজন অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট এ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ইমিগ্রেশনবিরোধী উদ্যোগ যে অতীতের যে কোনো প্রশাসনের উদ্যোগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর, এর আঁচ পড়েছে বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির ওপর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করা পর গত সাড়ে চার মাসে ১ লাখ ৫২ হাজার অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ লাখ অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে বহিষ্কার করেছিলেন। এবার তিনি আরও অধিকসংখ্যক অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে বহিষ্কার করার টার্গেট নির্ধারণ করেছেন।
অবৈধ ইমিগ্র্যান্টরা বহিষ্কার আতঙ্কে দিন কাটানোর পাশাপাশি তারা কীভাবে বহিষ্কারাদেশ এড়াতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করতে ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নিদের কাছে ভিড় করছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটের বহুসংখ্যক ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে যে, তাদের ক্লায়েন্টদের অনেকে বহিষ্কারাদেশ লঙ্ঘনের কারণে ইতোমধ্যে জরিমানার নোটিশ পেয়েছেন। তাদের কাউকে সর্বনিম্ন কয়েক হাজার ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ডলারের বেশি জরিমানা করা হয়েছে। নোটিশপ্রাপ্তরা কেন তাদের ক্ষেত্রে জরিমানা প্রযোজ্য নয়, তার উপযুক্ত কারণ সংবলিত দলিলপত্রসহ চ্যালেঞ্জ করার জন্য জারিকৃত নোটিশের তারিখ থেকে ৩০ দিন সময় পাবেন। কোনো অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট যদি তার ওপর ধার্যকৃত জরিমানা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে প্রশাসন জরিমানার অর্থ আদায়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। ইমিগ্রেশন আইন লঙ্ঘনের অপরাধে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ করার নোটিশ পাঠিয়েছে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট। কিন্তু জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ ইমিগ্র্যান্টের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনকে। তবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এখনো অভিযুক্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পদ্ধতি নির্ণয় করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তাদেরকে এ ধরনের জটিল কাজে নিয়োজিত হতে হয়নি।
ডিপোর্টেশনের আদেশপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে জরিমানার বিধান যে ট্রাম্প প্রশাসন করেছে তা নয়। এ বিধানের উৎস ১৯৯৬ সালে প্রণীত একটি আইন, যা প্রথমবারের মতো ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে কার্যকর করা হয় ২০১৮ সালে। মূল বিধানে জরিমানার পরিমাণ ছিল দৈনিক ৫০০ ডলার হারে। কিন্তু বর্তমান প্রস্তাবে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করে দৈনিক ৯৯৮ ডলার ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু তখন অভিযুক্তদের ওপর ধার্য করা জরিমানা আদায়ের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয় তেমন গুরুত্ব পায়নি। ওই সময় ট্রাম্প প্রশাসন নয়জন অবৈধ ইমিগ্র্যান্টের ওপর থেকে জরিমানা প্রত্যাহার করে, যারা আইনি লড়াইয়ের পর বিভিন্ন গির্জায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। নিউইয়র্কভিত্তিক ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি রবার্ট স্কটের এক মক্কেল, যিনি নিম্ন-আয়ের মেক্সিকান নারী এবং ২৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, তার ওপর ১৮ লাখ ডলার জরিমানা ধার্য করে নোটিশ এসেছে। অ্যাটর্নি স্কট তার পেশাজীবনে এ ধরনের কিছু দেখেননি। তার মক্কেলের ওপর ২০১৩ সালে চূড়ান্ত ডিপোর্টেশন আদেশ এলে ওই সময়ে তিনি এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ওই নারী গত বছর তার ডিপোর্টেশন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন, যা এখনো ইমিগ্রেশন আদালতে বিবেচনাধীন এবং তিনি আদেশ এড়ানোর জন্য আত্মগোপনেও ছিলেন না। এ ধরনের ঘটনা একটি নয়, হাজার হাজার। চূড়ান্ত ডিপোর্টেশন আদেশপ্রাপ্ত সবাইকে ঢালাওভাবে জরিমানা আরোপ করার উদ্যোগ নিয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং কারও আপিল আদালতে বিবেচনাধীন থাকলেও আপিল নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে না।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, বহিষ্কারাদেশপ্রাপ্তদের যে জরিমানা ধার্য করা হয়েছে, তাতে তাদের অধিকাংশের পক্ষেই জরিমানার অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এ ধরনের ইমিগ্র্যান্টদের প্রায় সবাই নিম্ন-আয়ের লোক। ট্রাম্প প্রশাসনও তা জানে। যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা নিয়ে বৈধভাবে আগত বিদেশিদের, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে আগতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের জন্য আবেদন করে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এ ধরনের ইমিগ্র্যান্টরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘অর্থনৈতিক শরণার্থী’। অনেকে বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পেলেই সন্তুষ্ট। তাদের অনেকের আবেদন অ্যাসাইলাম অফিস থেকে অথবা ইমিগ্রেশন আদালত থেকে অনুমোদিত হয়। আদালতে অনুমোদিত না হলে আবেদনকারী আপিল করতে পারেন এবং আদালত যদি আপিল নামঞ্জুর করেন, সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত বহিষ্কারাদেশ জারি করতে পারে।
অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার এল সালভেদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস ও ইকুয়েডরের। তারা সীমান্ত অতিক্রম করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাসাইলাম আবেদন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ডিটেনশন সেন্টারে আটক রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর ওয়ার্ক পারমিট লাভ করেন এবং বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও কাজ করেন। তাদের আবেদন অনুমোদিত না হলে বা বহিষ্কারাদেশ না পাওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অবস্থান বৈধ। যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রশাসন, তা ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান পার্টির হোক, সবার ইমিগ্রেশন নীতির অন্যতম লক্ষ্য থাকে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা। ডেমোক্র্যাটরা চুপিসারে কাজটি করে, কিন্তু রিপাবলিকানরা এ নীতি বাস্তবায়নে শোরগোল করে বেশি। ট্রাম্প প্রশাসনও তা-ই করছে।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক
