Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রাজনৈতিক সেতুবন্ধ

Icon

ড. শেখ আকরাম আলী

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক সেতুবন্ধ

ছবি: সংগৃহীত

যোগাযোগের জন্য সেতুর গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ‘রাজনৈতিক সেতু’র গুরুত্বও অপরিসীম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শেখ মুজিব তার দলের বামপন্থি অংশের প্রভাবে দেশকে ‘মুক্তিযুদ্ধপন্থি’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’, এ দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন এবং এর ফলে দেশ এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যায়, যা শেষ হয় শেখ মুজিবের পতন এবং জিয়াউর রহমানের উত্থানের মধ্য দিয়ে।

জিয়াউর রহমান জাতীয় সংহতি ও একতাবদ্ধতার গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি একটি দূরদর্শী পদক্ষেপ নেন, যা জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। এ রাজনৈতিক সমঝোতা তার আমলে শুরু হয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

যদিও এরশাদ গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন, তবুও সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পতন ঘটায়। এরপর বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নয় বছরের ব্যবধানে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া তার স্বামীর রাজনৈতিক নীতিকে অনুসরণ করেন এবং তার প্রথম মেয়াদে সফল নেতৃত্ব দেন। যদিও ভারতের প্রভাবশালী কূটনীতির কারণে ১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষমতা হারান, তবে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি তখন দেশের রাজনীতির নিয়মে পরিণত হয়।

খালেদা জিয়ার আপসহীন মনোভাব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক কৌশল তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রীতে পরিণত করে। তার নেতৃত্বে বিএনপি দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। জনগণ ২০০১ সালে পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আনে। এটি সম্ভব হয়েছিল শুধু তার গতিশীল নেতৃত্ব এবং জাতীয় স্বার্থে তার নিঃস্বার্থ নিষ্ঠার কারণে। তিনি কখনোই জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপস করেননি, এবং সম্ভবত এটিই বিএনপির পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান একটি নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দ্বার খুলে দিয়েছে, যা গত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে শেখ হাসিনার সময়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবের মতো ভারতের নির্দেশনায় সমাজে বিভাজন তৈরি ও শাসননীতি অনুসরণ করেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি নতুন সমঝোতার জন্য যথেষ্ট অনুকূল।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, খালেদা জিয়া সঠিকভাবে পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছেন এবং বিএনপি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি যখন দলের শীর্ষ নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে পরামর্শ দিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

অন্যদিকে সরকার বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বিএনপির অতীত অবদানকে অস্বীকার করতে পারবে না। জিয়াউর রহমান ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে জীবন দিয়েছেন। আর খালেদা জিয়া কখনোই জাতীয় স্বার্থে আপস করেননি। এই আপসহীন অবস্থানই তাকে গত আঠারো বছর ধরে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছে। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পেছনে তার অবদান ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

খালেদা জিয়াকে আজ সঠিকভাবেই ‘রাজনৈতিক সেতু’ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যিনি বিএনপির নেতৃত্ব এবং বর্তমান সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পেরেছেন। এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হতে যাচ্ছে। জনগণ ইতিবাচক রাজনৈতিক উন্নয়ন দেখার আশায় আছে। অতীতের মতো তিনি আবারও প্রমাণ করতে চলেছেন, তিনি একজন প্রকৃত ‘রাজনৈতিক সেতু’। আর বিএনপি আবারও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে সঠিক পথে এগিয়ে যাবে, যেমনটি অতীতে ছিল। এই বিশেষ মুহূর্তে তারা কোনো ভুল করতে পারেন না এবং জাতিকে হতাশ করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রফেসর ড. শেখ আকরাম আলী : ইতিহাসবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম