শুধরাতে হবে আমলা ও জনপ্রতিনিধিকে
সাঈদ খান
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১১ জুন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়ন বিএনপির আয়োজনে বলদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২৫-এর ফাইনাল। টুর্নামেন্টে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলা ও স্বরূপকাঠি থানার প্রশাসনিক অঙ্গনের সম্মানিত ব্যক্তিরা। প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. নাজিমুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন পিরোজপুর জেলার পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ আবু নাসের এবং সহকারী পুলিশ সুপার (নেছারাবাদ সার্কেল) সাবিহা মেহেবুবা। এছাড়াও সম্মানিত অতিথি ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) রায়হান মাহমুদ এবং নেছারাবাদ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. বনি আমিন।
এ আয়োজনে প্রধান বক্তা হিসাবে বক্তব্য দেন আবদুল্লাহ আল বেরুনী সৈকত, যিনি নেছারাবাদ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম। আয়োজনটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলাম এবং যুগ্মআহ্বায়ক মো. নাসিম রেজা চঞ্চল।
আমলারা মূলত রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্মচারী, যারা সরকার পরিচালনায় সহায়ক; কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকার কথা। তারপরও অনেক সময় দেখা যায় তারা রাজনৈতিক প্রোগ্রাম, মিছিল, সভা বা সমাবেশ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন; যা গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আজ যিনি আমলা, কাল তিনি রাজনীতিক, পরের দিন ব্যবসায়ী। এটাই তো সমস্যা। ওনারা বহুরূপে এখন আমাদের সামনে আসেন। অনেক ক্ষেত্রে এ তিনটি একই হয়ে গেছে।’
আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য জরুরি। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো-মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমান ভোটাধিকার এবং অংশগ্রহণমূলক শাসন, যা কার্যকর হয় যখন আমলাতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। নিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্রের বুনিয়াদ দুর্বল হয়ে যায় আর এর ফলে জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যদিকে যখন রাজনৈতিক দল বা নেতা জনগণের স্বার্থের বদলে নিজের দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন, তখন জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের ভুল চর্চা দেখা গেছে, যা মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং বিভাজন তৈরি করেছে। এমন রাজনীতি শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতির পথেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের শাসককে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শাসনে পরিণত করতে সহায়তা করে। শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে আমলা শ্রেণিকে তার রাজনৈতিক আদেশ বাস্তবায়নে একনিষ্ঠভাবে ব্যবহার করেন, তখন শাসক ও আমলার মধ্যে একটি জৈবিক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা গণতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং একনায়কত্বের পথকে সুগম করেছিল। আমলাতন্ত্র যদি দুর্নীতিগ্রস্ত, পক্ষপাতিত্বপূর্ণ এবং জনগণের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে, তখন তা একনায়কতান্ত্রিক আচরণের পৃষ্ঠপোষক হয়ে যায়, যা শাসককে আরও বেশি স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে; ফলে রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মরে যায়।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র একটি অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক প্রতিটি স্তরে আমলাতন্ত্রের অবদান রয়েছে। সুশাসন, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দক্ষ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
আমলাতন্ত্র কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার একটি যান্ত্রিক কাঠামো নয়, বরং একটি দক্ষ, পেশাদার ও সংগঠিত বাহিনী হিসাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান অংশ। সরকার গঠনের পর প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একে বাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা কল্পনাও করা যায় না।
বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ, তা ধনী হোক বা দরিদ্র-সব দেশেই একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র লালন করা হয়। এ বাহিনী প্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল এবং টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন। সরকারের আইন, নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এদের দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত চিন্তাবিদ প্রফেসর ফাইনার বলেন, ‘The function of the civil service in the modern state is not merely the improvement of government; without it indeed, government would be impossible.’ অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারব্যবস্থাকে কেবল উন্নত করাই নয়, বরং আমলাতন্ত্র ব্যতীত সরকারের অস্তিত্বই সম্ভব নয়।
সাধারণ মানুষ এখনো সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে, অথচ জনতাকে সেই সম্মান দেওয়ার মানসিকতা অনেক আমলার মধ্যেই নেই। তাদের পদমর্যাদা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জনগণের মনে একধরনের ভীতি ও শ্রদ্ধার মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আমলাদের আচরণে জনসেবার দায়বদ্ধতা প্রায়ই অনুপস্থিত। অধিকাংশ আমলা নিজেদের প্রশাসনের কর্তৃত্বশীল অংশ মনে করেন-সেবক নয়, যেন তারা একশ্রেণির শাসক। অথচ সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রে জনগণই হচ্ছে সর্বময় ক্ষমতার উৎস, আর আমলারা জনগণের করের টাকায় নিযুক্ত কর্মচারী। সেবাদানই যাদের দায়িত্ব, তাদের আচরণে যদি ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পায়, তবে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে। বাস্তবে এমন নজিরও রয়েছে-কোনো আমলাকে ‘স্যার’ না বলায় তিনি অপমানিতবোধ করেছেন। অথচ সম্মান আদায় হয় আচরণ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে নয়। আমলা হওয়া অবশ্যই কৃতিত্বের বিষয়; কিন্তু সে কারণে জনগণকে অবমূল্যায়নের অধিকার কারও নেই। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যেখানে নাগরিকের মর্যাদা সর্বোচ্চ, সেখানে একজন আমলার মুখ থেকে ‘স্যার’ শব্দটি সাধারণ মানুষের প্রতি উচ্চারিত হওয়া উচিত সম্মানের স্বীকৃতি হিসাবে। আমলাদের বোঝাতে হবে-তারা শাসক নন, জনগণের সেবক!
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। যদিও ১৯৭২ সালের সংবিধানে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করা হয়, তবুও আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর ধারা বহন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমলাতন্ত্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করছে।
আমলাতন্ত্রের দর্শন মূলত ম্যাক্স ওয়েবারের বর্ণিত আইনগত-নৈতিক কর্তৃত্বের (Legal-Rational Authority) ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তার মতে, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠিত হয় সুস্পষ্ট নিয়ম, নির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন এবং পেশাদারির ভিত্তিতে। আমলাতন্ত্রের কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক দ্বন্দ্বপূর্ণ হলেও একে অপরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক সরকার, অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নীতিনির্ধারণ করে আর আমলাতন্ত্র তা বাস্তবায়ন করে। তবে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতের ফলে গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়-এজন্য জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়ী। জনবিচ্ছিন্ন নেতারা কখনোই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেন না বরং নিজের স্বার্থকে গুরুত্ব দেন। এর ফলে রাষ্ট্র আমলাদের দুর্নীতির সুযোগ দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করে, যা জনগণের বিপক্ষে যায়। শেষ পর্যন্ত এসব পদক্ষেপ রাষ্ট্র ও শাসককে স্বৈরাচারী করে তোলে।
নির্বাচিত সরকার নীতিনির্ধারণ করলেও সেই নীতির বাস্তবায়ন আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। দক্ষ প্রশাসন ছাড়া গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র অপরিহার্য, পক্ষপাত ও দুর্নীতি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। গণতন্ত্র টেকসই করতে আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা জরুরি। তথ্য জানার অধিকার, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও কার্যকর সেবাদানের জন্য দক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হলে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয় এবং জনগণ সরাসরি সেবা পায়।
স্থিতিশীল প্রশাসনিক কাঠামো সরকার পরিবর্তনের সময় নীতিগত ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে কার্যকর আমলাতন্ত্র প্রয়োজন।
নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা আমলাতন্ত্রের মৌলিক দায়িত্ব। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ প্রশাসন অপরিহার্য। দুর্নীতির ফলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। জনগণের মতামত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে। জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনার আমলাতন্ত্র তাকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হিসাবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত, আইনের শাসন দুর্বল করা, মিডিয়া ও বিরোধী দল দমন, জনগণের আস্থা ধ্বংস এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ধ্বংসের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বার্থরক্ষা ও আইনের প্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব তাকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখে, যা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য।
গণতন্ত্রের সার্থকতা তখনই নিশ্চিত হয়, যখন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের কল্যাণে নিবেদিত থাকে। কিন্তু বাস্তবতায় আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই যেন জনগণের সেবক নয়, বরং প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আমলাতন্ত্র হয়ে উঠেছে দুর্ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, আর জনপ্রতিনিধিরা অনেক সময় দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যস্ত থেকে জনগণের কণ্ঠস্বর থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, গণতন্ত্র হারাচ্ছে প্রাণ, আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ছে জনবিচ্ছিন্ন। তাই আমলা ও জনপ্রতিনিধিকে শুধরাতেই হবে-তাদের মানসিকতায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন, ফিরিয়ে আনতে হবে দায়িত্ববোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, এটি প্রতিদিনের শাসন ও সেবায় ন্যায়বিচার। এ ন্যায়ের পথে ফিরতে হলে প্রশাসন ও রাজনীতিকে মানবিকতা ও নৈতিকতার সঙ্গে পুনরায় প্রতিস্থাপন করতে হবে।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
