Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইরান হয়েছে ইসরাইলের গলার কাঁটা

Icon

মেজর (অব.) মনজুর কাদের

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইরান হয়েছে ইসরাইলের গলার কাঁটা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী পরাশক্তিগুলো ইউরোপকে কেক কাটার মতো বিভক্ত করতে গেলে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। স্নায়ুযুদ্ধ, কোল্ড ওয়ার, শীতল যুদ্ধ, ঠান্ডাযুদ্ধ-যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, মূলত এটি ছিল দুটি প্রধান বিরোধী ব্লক, পুঁজিবাদী সমাজের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সরাসরি বড় ধরনের সামরিক সংঘাত/যুদ্ধের পরিবর্তে প্রকাশ্যে বা গোপনে হুমকি, প্রচারণা, গুপ্তচরবৃত্তি, গোপনে হত্যা এবং প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা।

‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ শব্দটি আগে আরও সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হলেও জর্জ অরওয়েলই প্রথম এটিকে আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সালের একটি প্রবন্ধে ব্যবহার করেছিলেন এবং বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালে শুরু হলে অরওয়েল সামরিক চাকরির জন্য অযোগ্য ঘোষিত হন, তার পরিবর্তে তিনি বিবিসির ভারতীয় বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৪৩ সালে বিবিসি ছেড়ে দেন এবং ব্রিটিশ শ্রমিক নেতা অ্যানিউরিন বেভানের সঙ্গে যুক্ত বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা ট্রিবিউনের সাহিত্য সম্পাদক নিযুক্ত হন। অরওয়েল বিভক্ত বিশ্বকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যুদ্ধ বা শান্তির কোনো অবস্থা পৃথিবীতে নেই, কখনো ছিল না, বরং তিনি বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে একটি ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

কোনো বিজয় চিরস্থায়ী নয়

কোনো বিজয় যে চিরস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে না, অরওয়েল তা বুঝতে পেরেই (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) দীর্ঘস্থায়ী একটি দ্বন্দ্ব বিশ্বকে আবারও অস্থির করে তুলবে-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এ অবস্থায় বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে থাকে। অনেক বড় দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নতুন নতুন দেশের জন্ম হয় (যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান), বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থান, আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাও বদলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যেও ঘটে অনেক অভিনব ঘটনা।

আরবদের তাড়িয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম

রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি এলাকায় বসবাস করত।? সেসময় ফিলিস্তিনি আরবদের কৃষিখামার ছিল গাজা থেকে দু’মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকায়। ১৯৩০-এর দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদিরাও কৃষিখামার গড়ে তুলেছিল এ এলাকায়। সে সময় মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। ব্যবসায়ী ইহুদিরা দলে দলে সেখানে এসে ভূমি ক্রয় করতে থাকে; ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারে, তারা ধীরে ধীরে সম্পত্তির মালিকানা হারাচ্ছে।

ইহুদিরা আলাদা রাষ্ট্র গড়তে চায়

ইহুদিরা ১৮৯৭ সাল থেকেই চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। ফিলিস্তিনের ভূমি ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে তুরস্কের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সার্বিক সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে, যা ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ব্রিটেন ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ফিলিস্তিনের মাটিতে তাদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দেওয়া হবে।

১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন, যার কারণে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে থাকে। তখনই ফিলিস্তিনিদের হুঁশ ফিরে। তারা বুঝতে পারে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। তবে আরবদের মধ্যে কোনো ঐক্য ও সমন্বয় না থাকায় ইহুদিরা একের পর এক কৌশলগত জায়গা দখল করে নেয় এবং দখল করতে করতে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্র তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত আরব দেশগুলোর বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং শিয়া মতাবলম্বী ইরানের ওপর নজর দেয়?। এ কাজে তারা সুন্নি মুসলমানদের ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।

ইরানের রাজতন্ত্র

রেজা খান, পরবর্তীকালে রেজা শাহ পাহলভি, (জন্ম : ১৮৭৮, মৃত্যু : ১৯৪৪) ছিলেন ইরানের শাহ (সম্রাট)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির চাপে ১৯৪১ সালে তাকে সিংহাসন ছাড়তে হয় এবং তার ছেলে মোহাম্মদ রেজা পাহলভি তার স্থলাভিষিক্ত হন। ক্ষমতা গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল কম। কমবয়সি শাহ অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের পরামর্শ না নিয়ে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

স্নায়ুযুদ্ধের কবলে ইরান

ইরানে ১৯৪৯ সালে শাহকে হত্যার একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর তিনি সোভিয়েতপন্থি রাজনৈতিক দল ‘তুদেহ পার্টি’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আঞ্চলিক অস্থিরতা আর স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শাহ নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের অপরিহার্য মিত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হন, ইরানে মার্কিন স্বার্থরক্ষায় তার কোনো বিকল্প নেই।

পশ্চিমাদের নজর ছিল তেলের খনিগুলোর দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ইরানের ভূখণ্ডে প্রচুর তেলসম্পদ আবিষ্কার হয়, যা ছিল ইরানের অন্যতম প্রধান সম্পদ। তেল আবিষ্কারের মূলে ছিল বিভিন্ন ব্রিটিশ কোম্পানি। ফলে যত তেলের খনি আবিষ্কার হয়েছে, তার অধিকাংশের মালিকানা চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। এসব তেল বিক্রির টাকার কোনো উপকারিতা পেতেন না ইরানের সাধারণ নাগরিকরা। অন্যদিকে শাহ বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে থাকেন।

জাতীয়তাবাদী নেতার আবির্ভাব

ঠিক এ সময়টিতে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা, দেশের সব তেলসম্পদ জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্রিটেনে তখন উইনস্টন চার্চিল ক্ষমতায় আর যুক্তরাষ্ট্রে হেনরি ট্রুম্যান। মোসাদ্দেকের জয়লাভের ফলে দুই ক্ষমতাশালী নেতার মাথায় ভাঁজ পড়ে। শুরু হয়ে যায় মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার নীলনকশা।

ক্ষিপ্ত ব্রিটেন ইরানের তেল উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়। লন্ডন ওয়াশিংটনকে বোঝাতে সক্ষম হয়, এতে এমন ঝুঁকি আছে যে, ইরান কমিউনিস্ট শিবিরে যোগ দিতে পারে।

সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান

ব্রিটেনের প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে দ্রুত কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইরানের শহরগুলোতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোসাদ্দেকের জনপ্রিয়তা ছিল। অপরদিকে সমাজের কিছু শক্তিশালী অংশের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ইরানের শাহ ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে; কিন্তু প্রথম দফায় তা ব্যর্থ হয়। শাহ তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে বাগদাদ চলে যান। তবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে দ্বিতীয় দফা অভ্যুত্থানে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন জেনারেল জাহেদি। এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল মার্কিন ও ব্রিটিশ দুই গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ ও এমআই সিক্স। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন চাইছিল, যেন তেলসমৃদ্ধ দেশটির সর্বময় নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমা সমর্থক শাহের হাতেই থাকে আর সেটিই তখন অর্জিত হয়েছিল।

‘সম্রাট’ ঘোষণা

অভ্যুত্থানের পর মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯৬৭ সালে নিজেকে ইরানের সম্রাট (রাজাদের রাজা) এবং স্ত্রী ফারাহ দিবাকে সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করে মুকুট পরেন। তার এমন ঘোষণায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। শাহ ১৯৬৩ সালে ‘হোয়াইট রেভলিউশন’ নামে একটি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ছিল ভূমি সংস্কার, নারীদের ভোটাধিকার সম্প্রসারণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণের মতো কার্যক্রম। নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করার পর তার গৃহীত এসব কার্যক্রম আরও গতি পায়। এর মাধ্যমে শাহ পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতি ভাবধারায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। ইরানে ধীরে ধীরে পশ্চিমা সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, অভ্যাস প্রভাব ফেলতে শুরু করে। যদিও রাজধানী তেহরানের বাইরে পশ্চিমা প্রভাব তেমন বিস্তার লাভ করতে পারেনি।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির উত্থান

শাহের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ধর্মীয় নেতাদের শঙ্কিত করে তোলে। তাদের অনেকেই রাজবংশের নানা আচার-আচরণ সহজভাবে দেখতেন না। ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরানের শাহের পশ্চিমাপন্থি শাসনের বিরোধিতা করতে থাকেন। দেশের শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুভূতি আলাদা করার শাহের প্রচেষ্টা দেখে খোমেনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

বৈদেশিক শক্তিকে দেশের ভেতর ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য শাহের ব্যাপক সমালোচনা করেন খোমেনি। শাহ যখন ইরানে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যদের দায়মুক্তির সুযোগ করে দেন, তখন খোমেনি আরও জোরালোভাবে তার বিরোধিতা করেন। ইরান রাষ্ট্রের পরিচয় এবং এর গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শাহের শাসনের তীব্র বিরোধিতার জন্য ১৯৬৪ সালে খোমেনিকে নির্বাসনে যেতে হয়। তিনি প্রথম যান তুরস্কে, তারপর ইরাকে, শেষে ফ্রান্সে। সেখান থেকেই তিনি শাহকে উৎখাত করার জন্য তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান।

চৌদ্দ বছর ধরে দেশের বাইরে থাকা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, অন্যদিকে ধীরে ধীরে শাহের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। শাহের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়তে থাকায় ধর্মীয় নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ১৯৭৬ সালে শাহ ইসলামিক ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে ‘ইমপেরিয়াল’ ক্যালেন্ডার চালু করেন। তার এ কাজগুলোকে দেখা হচ্ছিল ইসলামবিরোধী হিসাবে।

ইসলামি বিপ্লব

ইরানে পশ্চিমাসমর্থিত শাহের স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি এবং সামাজিক অবিচার জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। শাহের পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ এবং ধর্মনিরপেক্ষীকরণ প্রচেষ্টা ঐতিহ্যবাহী ইরানি সংস্কৃতির অনুসারীদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।

শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল শাহের পূর্বপুরুষ কুরুশ আড়াই হাজার বছর আগে। সেই বংশের শেষ সম্রাট ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি বিপ্লবী দেশবাসীর কাছে পরাজিত হয়ে মিশরে পলায়ন করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল একটি গণভোটের মাধ্যমে ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি খোমেনির নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে।

পশ্চিমারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে

ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়, যেখানে ইসলামি আইন ও শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ইসলামি আন্দোলনের ঢেউ সৃষ্টি করে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি শত্রুতা শুরু হয়।

ইরান আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়

ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ বিপ্লবটি কেবল ইরানের ইতিহাসের নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়। এ বিপ্লবটি ছিল ইরানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং এর ব্যাপক প্রভাব ছিল মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব রাজনীতিতে।

তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল

১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর ছাত্র-যুবকরা তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল করে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দম্ভ, অহঙ্কার এবং ক্ষমতায় একটি বড় ধরনের আঘাত তৈরি হয়, বড় একটি প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। আর সেই ঘটনার প্রভাব পরবর্তীকালে ইরানের রাজনীতিতে যেমন আছে, ঠিক তেমনি এটির একটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্যও তৈরি হয়।

সেদিনের সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আজও দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর একের একের এক অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকার সেসব নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবিলা করে ইরান টিকে আছে আত্মমর্যাদা নিয়ে। সফল ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান তার নিজস্ব ঢংয়ের রাজনীতি এবং প্রশাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে, যার মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব ঢুকতে পারছে না।

পারমাণবিক শক্তি

মধ্যপ্রাচ্যের একটিমাত্র দেশ ইরান, যে দেশটি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। দেশটি জানে, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হলে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে হবে। উদাহরণ তাদের সামনে আছে।

১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত আণবিক বোমা ফাটিয়ে উপমহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় এবং তার বিপরীতে পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ, যারা ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আবার ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। ইরান অনুরূপভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইসরাইলের অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রের বিপরীতে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে চাইছে।

ইসরাইল ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি

ইরান দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির কথা বলে আসছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক চুল্লি তৈরি অন্যতম। কিন্তু একইসঙ্গে দেশটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, যা পারমাণবিক বোমা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

ইসরাইল পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করে না, অস্বীকারও করে না এবং বলেছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র চালু করবে না। তবুও সর্বজনীনভাবে বিশ্বাস করা হয়, ইসরাইলের কাছে আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সংরক্ষিত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যদিও এটি স্পষ্ট নয়, ঠিক কতগুলো অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে।

ইরান কি পারমাণবিক বোমা প্রদর্শন করবে

সাম্প্রতিককালে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে হামলা-পালটা হামলার ঘটনা ঘটছে। দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের বিভিন্ন খবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। ইরানের বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে থেকে দেশটি এ পর্যন্ত গর্বের সঙ্গে টিকে আছে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এ অবস্থায় ইরান যদি পারমাণবিক বোমা প্রদর্শন করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে যে ব্যাপক পরিবর্তন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভয় এখানেই। পাশাপাশি দুটি মুসলিম দেশ, পাকিস্তান ও ইরানের আণবিক বোমার অধিকারী হওয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব কল্পনাও করতে পারছে না। এর অর্থ হলো, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কর্তৃক সৃষ্ট মাত্র এক কোটি লোকের বসবাসের ইসরাইল রাষ্ট্র বিলুপ্ত হওয়া, যার প্রত্যাশা ফিলিস্তিনিরা করছেন। দ্বন্দ্বটা এখানেই, যার মীমাংসা করার ক্ষমতা কারও নেই। কী ঘটবে, তা শুধু ভবিষ্যতেই দেখা যেতে পারে, এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম