Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংকট কি কাটল

Icon

জিয়া আহমদ

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকট কি কাটল

ছবি: সংগৃহীত

গত ১৩ জুন লন্ডন সফরকালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি দুই নেতা আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও আলোচনা করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আগে ঘোষণা দিয়েছিল যে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনে করেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের একাধিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কারণে এপ্রিল মাস জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য উপযোগী সময় নয়। সে কারণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী রমজানের আগেই অনুষ্ঠানের জন্য অনুরোধ জানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন যে, রোজার মাস শুরুর এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন আয়োজন করা যায়, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসরদের বিচার এর আগে দৃশ্যমান করা সম্ভবপর হয়। তারেক রহমান তার প্রস্তাবিত বিষয়কে আমলে নেওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানান। পরে উভয় পক্ষ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।

আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দেশে চলমান নানা ষড়যন্ত্র ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের এ সাক্ষাৎকার ও আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা এখন আশা করছে, বড় কোনো সংঘাত ছাড়াই আগামী মাসগুলো কেটে যাবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ প্রায় ১৭ বছর পর একটি উন্মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা আগামীর নির্বাচিত সরকার দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন এবং দেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য এ আশাজাগানিয়া খবর যে দেশের সব মানুষকে আনন্দ ও স্বস্তি দিয়েছে তা কিন্তু মনে হচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের আলোচনা এবং যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াটি চোখে পড়ে, তা দেশের একটি নবীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ এক নেতা করেছেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত বিদেশের মাটিতে একটি দলের সঙ্গে বৈঠকে স্থির হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, ইউনূস-তারেক বৈঠকে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে এবং সংস্কার ও বিচার এজেন্ডার পেছন দিকে চলে গিয়েছে। একই দলের অন্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন এবং এ বৈঠক নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন যে, তা মেনে নেওয়া যায় না। এ দল দুটিই বলছে, তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে ড. ইউনূস একটি দলের (অর্থাৎ বিএনপির) পক্ষ নিয়েছেন! অথচ গত দশ মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শনের অভিযোগে বহুবার অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এর ফলে কিছুটা হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বস্তুত এ বৈঠকে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে বিএনপি অনেক বড় ছাড় দিয়েছে। তারা দেশে নির্বাচনের সেরা সময় ডিসেম্বরের বদলে ফেব্রুয়ারিতে (রমজানের আগে) নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়ে যথেষ্ট নমনীয়তাও দেখিয়েছে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের ফিরে আসা বা অন্য কোনো দৈবদুর্বিপাকের কারণে ফেব্রুয়ারির প্রথমে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করা গেলে যৌক্তিক কারণেই পরবর্তী এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে তা অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকছে না। আবার আগামী জানুয়ারিতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কথা রয়েছে, যা এপ্রিল-জুনের আগে শেষ হবে না। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, নতুন ভোটাররা কি আগামী পাঁচ বছর ভোট না দিয়েই অপেক্ষা করবে? ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে এ সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হতো না। তা ছাড়া দেশের সেনাবাহিনীও ডিসেম্বরে নির্বাচন প্রত্যাশা করছিল। বর্তমান বৈঠকের যৌথ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্বও তৈরি হতে পারে! বিএনপি এ রকম অনেক সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেও দেশকে রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত রাখার জন্য এ বৈঠকে যোগদান ও যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে। এবং সরকারও বিষয়টিকে বিবেচনা করে জনস্বার্থে তার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারপরও দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি এ দলগুলো এ বৈঠক ও তার যৌথ ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যা সত্যই বিস্ময়কর!

এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যাবে, তারা ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ চেতনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন হলো, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা’ জিনিসটা কী? জুলাইয়ের প্রথম দিকে সরকারি চাকরিতে ‘কোটা প্রথা’ পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ‘শিলিগুড়ি বাই-পাসের’ জন্য রেল করিডর প্রদান এবং মংলা বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব ভারতকে দেওয়ার প্রাক্কালে জনগণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তৎকালীন বশংবদ হাইকোর্টের মাধ্যমে এ কোটাব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার নাটক সাজানো হয়েছিল। প্রথমদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সামনে বেশ কজন ছাত্রলীগারকে রাখা হয়েছিল, যাতে সরকারের সুবিধামতো সময়ে আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ যেভাবে আত্মবিসর্জন দিলেন, তাতে স্বৈরাচারী সরকারের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। বস্তুত আবু সাইদের এ আত্মত্যাগের সমতুল্য আত্মবিসর্জন পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল এক ঘটনা। টিভিতে সরাসরি প্রচারিত এ দৃশ্য দেখার পর কোনো মানুষের পক্ষে আর ঘরে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। ছাত্ররা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে, আর তাদের সঙ্গে রাজপথে নেমে আসে দেশে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। সে সময় দেশের সব মানুষের একমাত্র দাবি ছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগ। স্বৈরাচারী হাসিনা তার অনুগত সব বাহিনীকে নামিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। অবশেষে ১৬০০-২০০০ মানুষের জীবন, ২০-৩০ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ববরণের প্রেক্ষাপটে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে, তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

উপর্যুক্ত বর্ণনা থেকেই ‘জুলাই চেতনা’কে সংজ্ঞায়িত করা যায়। মূলত শেখ হাসিনার পতন এবং তার মতো স্বৈরাচার যাতে আর কোনো দিন বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসতে না পারে, সে বিষয়টিই জুলাইয়ের চেতনা বলে দাবি করা যেতে পারে। একইসঙ্গে পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসরদের বিচার অনুষ্ঠান করাও জুলাই দাবিনামার অংশ হতে পারে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই সম্পূর্ণ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রতিষ্ঠা না হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ দাবিগুলোর কোনোটিই অন্য কোনোটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। উল্লেখ্য, ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠকে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং বিচার ও সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। এ কথা অনস্বীকার্য, এ দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐকমত্য ছাড়া কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার রাজি হলেই যে সেগুলো কার্যকর হবে, আমাদের অতীত ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। গত ১/১১-এর সরকারও বেশকিছু সংস্কার করেছিল। কিন্তু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ওই শাসনামলকেই বৈধতা দেননি, ফলে তাদের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমও হারিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুরের গডফাদার তাহেরের ছেলে বিপ্লব লক্ষ্মীপুর বিএনপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার লাশ টুকরা টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারিক আদালতে বিপ্লবকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় আপিল বিভাগে অনুমোদিত হলেও অভিযুক্ত বিপ্লব মাত্র ১০ বছর রাজার হালে জেলে থেকে মুক্ত হয়ে পালিয়ে গেছে।

লন্ডনে অনুষ্ঠিত ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠকে বিএনপির বাস্তবিক লাভ খুব বেশি হয়নি। বরং এতে নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু ও আনন্দমুখর পরিবেশে করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সুফল ভোগ করবে দেশের সব মানুষ ও অংশগ্রহণকারী সব দল। আর সে কারণে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। যারা এ বৈঠকে অন্য কিছু খুঁজছেন, তারা ভুল করছেন। বৈঠকের মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যারা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন, তারা এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তাদের নির্বাচন ভীতি ও দেশের ভোটারদের প্রতি আস্থাহীনতাই প্রকাশ করছেন, যা আখেরে তাদেরই ক্ষতি করবে। দীর্ঘ ১৭ বছর নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগবঞ্চিত দেশের মানুষ এ বৈঠকের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে এসেছে, যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সবাইকে এক হয়ে আগামী নির্বাচনকে সফল করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত দেশ গঠনের কাজটা এগিয়ে নিতে সক্ষম হব।

জিয়া আহমদ, এনডিসি : লেখক সাবেক সরকারি কর্মচারী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম