শতফুল ফুটতে দাও
ভালো গণতন্ত্রের জন্য কি আশাবাদী হওয়া যায়
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কারণে-অকারণে আজকাল আমাকে বিভিন্ন ধরনের ফোরামে কথা বলতে হয়। এসব ফোরামে যখন কথা বলি, তখন শুনি এর চেয়েও অনেক বেশি। এসব ফোরামে আলোচনা করতে গিয়ে শুনি, ’২৪-এর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রদেহে সর্বাত্মক পরিবর্তন চায়। অভ্যুত্থানে প্রধান স্লোগান ছিল বৈষম্যবিরোধিতা। কাজেই, শেখ হাসিনার শাসনের অবসানে মানুষ ধারণা করল বাংলাদেশ বৈষম্যহীন হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। বৈষম্যের পরিবর্তে সাম্যের চিন্তা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। বৈষম্য একমাত্রিক নয়। এক ধরনের বৈষম্যের অবসান করতে গিয়ে অন্য ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই কীভাবে বৈষম্য থেকে সাম্যের ইকুইলিব্রিয়ামে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা যে কোনো ধীশক্তিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানীর জন্যও নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ। কার্ল মার্কস্ তার ক্রিতিক অব গোথা প্রোগ্রামে লিখেছেন, সমাজতন্ত্র এলেও সর্বাত্মক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। দৃষ্টান্তটি হলো, ধরা যাক দুজন মজুর একই সমান মজুরি পায়। কিন্তু তাদের একজনের সন্তানের সংখ্যা ২ এবং অন্যজনের সন্তানের সংখ্যা ৪। তাহলে কি তারা একই সমান জীবনযাত্রার মান ভোগ করতে পারবে? নিঃসন্দেহে নয়। জনমিতিক কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এ দুজন মজুর সমপরিমাণ কাজের জন্য সমপরিমাণ মজুরি পান। তাদের মধ্যে মজুরি সাম্য আছে, কিন্তু জীবনযাত্রার সাম্য নেই।
জুলাই অভ্যুত্থানে যারা ভ্যানগার্ড ছিলেন, তারা বৈষম্য নিয়ে কতটা গভীর চিন্তা করতে পেরেছেন? বিদ্যমান সমাজের প্রধান বৈষম্যগুলো ভেঙে দিতে হলে, সমাজজুড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতে হতো। সেই ঝাঁকুনি ধরা কাঁপিয়ে দেওয়া ভূমিকম্পের মতো। বিশাল অভ্যুত্থান হয়েছে বটে, কিন্তু এ অভ্যুত্থান ধরাকাঁপানো ভূমিকম্পের মতো প্রবল ছিল না। অভ্যুত্থানটি নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণের চণ্ডালিনী রূপিনী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল বটে, কিন্তু তার ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার ভিতে সামান্য কম্পন ছাড়া বিশেষ কিছু অর্জন করতে পারেনি। এ দেশে অতীতে আরও অনেক অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু সেসব অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের বাসভবন ও ক্ষমতার গদিতে স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার Citabel of power গণভবন জনতার দখলে চলে গিয়েছিল। জনতা গণভবনের চওড়া দেওয়াল ও লৌহনির্মিত দরজা ছিন্নভিন্ন করে প্রবেশ করেছিল। গণভবনের মূল্যবান ও আকর্ষণীয় জিনিসগুলোর লুটপাট ঘটিয়েছিল জনতার একাংশ এবং অন্যদিকে জনতার আরেকটি অংশ সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের তিমির অবসানে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে গিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিল। তারা কেঁদেকেটে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছে এই বলে যে, তিনি জালেমের হাত দুখানি ভেঙে দিয়েছেন। আওয়ামী সমর্থকরা জনতার এ উত্থানের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারে না। শুধু বলে, এটি একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্ত বুনট ষড়যন্ত্রের ফল। তারা অদ্ভুতভাবে বলে, জনতাকে নেশাযুক্ত পানি পান করিয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তারা আরও বলে, আন্দোলনকারী জনতা পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিয় জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ডকে বীভৎস করে তুলেছে। অর্থাৎ গোটা অভ্যুত্থানটিই ছিল বিশাল ষড়যন্ত্রের ফল, স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিণতি নয়।
আন্দোলনটির বড় দুর্বলতা ছিল, এটি কোনো সুসংগঠিত ভ্যানগার্ড রেভুলিউশনারি পার্টির দ্বারা পরিচালিত হয়নি। এর ছিল না কোনো সুলিখিত, সুস্পষ্ট কর্মসূচি। এ অভ্যুত্থানের ভেতরে বিভিন্ন শ্রেণিগোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটলেও এটি হয়ে ওঠেনি শোষিত, নির্যাতিত জনতার মুক্তিফ্রন্ট। রাজধানীর দেওয়ালে দেওয়ালে চমৎকার সব গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল। এগুলোর অনেকটার মধ্যে ছিল ছন্দময়তার সুর। এ গ্রাফিতিগুলোতে নানা ধরনের বৈষম্য উচ্ছেদের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু নানামুখী এসব বৈষম্য নিরসনে কীভাবে আন্দোলনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমন্বায়িত করা যায়, তার কর্মসূচি তৈরি করার জন্য কোনো দার্শনিক নেতৃত্ব ছিল না। বিশাল ধরনের সমাজ পরিবর্তনের প্রয়াসে কিংবা বিপ্লবে দার্শনিক নেতৃত্বের উপস্থিতি অপরিহার্য। মোনাকার্ডা ফোর্টে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর যখন বিচার হচ্ছিল, তখন ক্যাস্ত্রো তার আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ‘Condemn me, history will absolve me’ শিরোনামে পরিচালিত। এ ভাষণে ক্যাস্ত্রো ক্ষমাভিক্ষা করেননি, বরং বলেছিলেন, আমাকে দণ্ড দাও, ইতিহাস আমাকে দায়মুক্তি দেবে। এ ভাষণে ক্যাস্ত্রোর দার্শনিকতা অপূর্বরূপে ফুটে উঠেছিল। তিনি ধর্মীয় ও সেকিউলার দর্শন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ ন্যায্য। বলুন তো, কজনের পক্ষে এমন ব্যতিক্রমী মন্ত্র উচ্চারণ সম্ভব। ক্যাস্ত্রো ও তার কমরেড চেগুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব সফল হয়েছিল। ডিক্টেটর বাতিস্তা কিউবা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ’২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে যেসব যুবক নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের বয়স বিপ্লবকালে ক্যাস্ত্রোর যে বয়স ছিল তারই অনুরূপ। বয়সে এক হলেও কোথাও যেন এ দুই পক্ষের মধ্যে বিরাট ফারাক। কার্যত বোঝা যাচ্ছে, এখন এ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য খুবই সীমিত। এটি পোশাকি গণতন্ত্রের মধ্যে সীমিত থাকবে বলে ধারণা করি।
এখন মনে হয় প্রত্যাশার বেলুন ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। মনে হয় পোশাকি গণতন্ত্র পেলেই অনেক পাওয়া হয়ে যাবে। গণতন্ত্র ইন ফর্ম পাওয়া গেলই যথেষ্ট, গণতন্ত্র ইনসাবস্টেন্স কারোর মাথাব্যথার কারণ নয়। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের নামে ‘যেন যেন’ খেলছে। অনেকটা কচি শিশুদের পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মতো। আসলে প্রকৃত গণতন্ত্র কারোর কাম্য কিনা সেটাই প্রশ্ন।
সম্প্রতি ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটির আলোচনার সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, কাঠামোগত পরিবর্তনের বিশাল আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসছে। তবু এখন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগিয়ে যেতে হবে। গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের কেউ কেউ বলেন, গণতন্ত্র মানেই নির্বাচনি গণতন্ত্র নয়। নাগরিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রের টেকসই রূপান্তর হবে না। তাই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও নির্বাচনি গণতন্ত্রের সম্মিলন ঘটাতে হবে। এ বক্তারা কি এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি চাইছেন? এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি হলো : Athenian democracy, a form of direct democracy, emerged in ancient Athens around the 5th century BC and was characterized by citizen participation in public affairs.
বাংলাদেশের মতো ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কীভাবে অর্জন করা যায়, তার কোনো রূপরেখা প্রবক্তাদের আলোচনা থেকে আসে না। তবে যদি জনগণের মধ্যে বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ, আর্থিক সচ্ছলতা এবং জাতিগোষ্ঠী অনুযায়ী বিভিন্ন স্বার্থে গ্রুপের প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতাধরদের মধ্যে একটি কাউন্টার ভেইলিং শক্তি সূত্র গড়ে ওঠে, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য অর্জনে কিছু অগ্রগতি ঘটবে এবং সেই পরিমাণে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অর্জিত হবে। তবে এখনো যারা ক্ষমতাহীন এবং দুর্বল, তাদের শক্তি অর্জনে শক্তিমানরা খুব সহজে সুযোগ করে দেবে এমনটি দুরাশা মাত্র। এর জন্য প্রয়োজন হতে পারে একটি দর্শনসংবলিত সুসংগঠিত গণবিপ্লব। গোলটেবিল বৈঠকটিতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ তার ব্যক্তিগত মন্তব্য প্রকাশ করে বলেছেন, এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক উত্তরণে ২টি করণীয় দেখছেন। তার ভাষায়, ‘আসল কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো, কার্যকর করা। দ্বিতীয় হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সম্মিলিত শক্তির একটা সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করা। এটা এখনকার যেসব রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের মাধ্যমে করার সম্ভাবনা আমি প্রায় দেখি না।’ অধ্যাপক আলী রীয়াজের উপলব্ধির সঙ্গে আমার উপলব্ধির তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না। তছনছ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সুঠামভাবে উঠে দাঁড়াবে এমন সম্ভাবনা এখন দেখছি না। যে হিউম্যান ম্যাটেরিয়াল এখন অ্যাভেইলেবল আছে, তাদের দ্বারা সুষ্ঠু কিছু দাঁড়াবে এমনটি আশা করতে পারি না। কথায় বলে, ধানগাছে কি তক্তা হয়? তক্তা হয় এমন গাছ বড় হয়ে উঠতে ৩০-৪০ বছরের প্রয়োজন। সে সময় পর্যন্ত কি অপেক্ষা করার সুযোগ আছে? কারণ অর্থনীতিবিদ কিন্স বলেছেন, ‘In the long run we are all dead’.
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

