নিউইয়র্কের চিঠি
আমেরিকা কি রাজনৈতিক ঘাতকের দেশ হতে যাচ্ছে
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ১৪ জানুয়ারি মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেট দলীয় একজন আইনপ্রণেতা ও তার স্বামীকে তাদের বাড়িতে গুলি করে হত্যা এবং একই রাজ্যের অপর এক ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতা ও তার স্ত্রীকে গুলি করে গুরুতর আহত করার ঘটনা ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধির সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। দুই আইনপ্রণেতার বাড়ির দূরত্ব পাঁচ মাইল এবং ঘাতক আধা ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে দুটি ঘটনা ঘটিয়েছে। উভয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ ইতোমধ্যে ভ্যান্স লুথার বোয়েলটার নামে ৫৭ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টা এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগ এনেছে। ঘাতক পুলিশের ইউনিফর্ম পরিধান করে একটি লালবাতিযুক্ত গাড়িতে তার হত্যা-তালিকাভুক্ত আইনপ্রণেতাদের বাড়ি গিয়েছিল। তার গাড়ি থেকে তিনটি একে ৪৭ রাইফেলসহ মোট পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার নোটবুকে কংগ্রেসম্যান ও স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৪৫ জনের নাম-ঠিকানাসহ একটি তালিকা পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। ঘাতক অপর এক আইনপ্রণেতার বাড়িতে গিয়ে তাকে পায়নি। নিহত আইনপ্রণেতার নাম মেলিসা হর্টম্যান ও তার নিহত স্বামীর নাম মার্ক। আহত আইনপ্রণেতা ও তার স্ত্রীর নাম যথাক্রমে জন হফম্যান ও ইভেট।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতার জের হিসাবে কংগ্রেসম্যান ও রাজ্য আইনসভার সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কংগ্রেশনাল পুলিশ ২০১৭ সালে এ ধরনের ৩৯৩৯টি ঘটনা তদন্ত করেছে। কিন্তু গত সাত বছরে রাজনৈতিক হুমকির ঘটনা এত বেড়েছে যে, ২০২৪ সালে কংগ্রেশনাল পুলিশকে ৯৪৭৪টি ঘটনা তদন্ত করতে হয়েছে। এসব হুমকির কোনো কোনোটি বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের নিজস্ব সমীক্ষা অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩০০টি ঘটনা ঘটেছে।
মিনেসোটা রাজ্যের আইনপ্রণেতা ও তার স্বামীকে হত্যা এবং অপর আইনপ্রণেতাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ঘাতকের মোটিভ সম্পর্কে তদন্তকারীরা এখনো নিশ্চিত হতে না পারলেও হত্যা ও হত্যা চেষ্টার ধরন থেকে তারা ধারণা করছেন, ঘটনাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি বড় ঘটনা ঘটেছে পেনসিলভেনিয়ায়। ১৩ এপ্রিল সেখানে রাজ্যের ডেমোক্রেট গভর্নর হোজ শাপিরোর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় সন্দেহভাজন কোডি বালমার (৩৮)। লোকটি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন যে, তার কাছে যদি একটি হাতুড়ি থাকত, তাহলে তিনি গভর্নরকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতেন। তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। গভর্নর শাপিরো যদিও তার বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের সমাজে এ ধরনের সহিংসতার স্থান নেই এবং ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয় দল ও সবার উচিত এসব ঘটনার নিন্দা করা; কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও কাঠামোগুলো ক্রমেই ভেঙে পড়ায় সুযোগসন্ধানীরা ক্রমবর্ধমান হারে সহিংতার আশ্রয় গ্রহণ করছে।
টেসলার ইলন মাস্ককে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সির দায়িত্ব প্রদানের পর তিনি ফেডারেল ব্যয় সংকোচনের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করছিলেন, প্রশাসন সেগুলো কার্যকর করতে শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে টেসলার শোরুমে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা এসব ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের আইনের মুখোমুখি করে কয়েক দশক পর্যন্ত কারাদণ্ড দানের ব্যবস্থা করা হবে বলে হুমকি দেওয়ার পরও হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর জুলাইয়ে তার নির্বাচনি প্রচারাভিযান চলাকালে পেনসিলভেনিয়ার বাটলারে এক সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এক আততায়ী তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার এক কান স্পর্শ করে যায়। বিশ বছর বয়স্ক হত্যা চেষ্টাকারী টমাস ক্রুকস ট্রাম্পের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেও তিনি মাথা একদিকে ঝোঁকানোর ফলে অল্পের জন্য রক্ষা পান। কিন্তু একাধিক গুলিবর্ষণের কারণে সমাবেশে উপস্থিত এক ব্যক্তি নিহত ও দুজন আহত হন। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের পালটা গুলিতে টমাস ক্রুকস ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তার হামলার মোটিভ সম্পর্কে এফবিআইর তদন্তকারীরা কিছু জানতে পারেনি। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে হত্যা চেষ্টার পর ট্রাম্পের ওপর বন্দুক হামলার ঘটনাটি কোনো প্রেসিডেন্ট অথবা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর ওপর হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ উদ্যোগ ছিল। ট্রাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বেশ কয়েকটি এজেন্সির পক্ষ থেকে তদন্ত পরিচালনা করা হয়। উদ্ভূত বিতর্কে সিক্রেট সার্ভিস ডাইরেক্টর কিম্বারলি চিটল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এ ঘটনার দুই মাস পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর দ্বিতীয় দফা হত্যা চেষ্টা চালানো হয় ফ্লোরিডায় তার এক ক্লাবে গলফ খেলার সময়। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা রায়ান রোথ নামে এক সন্দেহভাজন বন্দুকধারীকে আটক করেন। গলফ কোর্সের পাশে এক ঝোপ থেকে তিনি একটি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে ট্রাম্পকে গুলি করার জন্য তাক করার সময় সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা তাকে আটকে ফেলেন। তদন্তকারীরা দেখতে পান, তিনি প্রথমে ট্রাম্প সমর্থক ছিলেন এবং ২০১৬ সালে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীকালে কট্টর ট্রাম্পবিরোধী হয়ে ওঠেন। ২০২৩ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ইউক্রেন’স আনউইনেবল ওয়ার’ শীর্ষক এক বইয়ে ট্রাম্পকে হত্যা করার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। রায়ান রোথের বিরুদ্ধে একজন প্রধান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে হত্যা করার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। আদালতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে অবশিষ্ট জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করার পর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস কর্তৃক নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে নিশ্চিতকরণের দিনে ওয়াশিংটন ডিসিতে ওই সময়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ভাষণের পর হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে ও নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর হামলা চালিয়ে ইউএস ক্যাপিটল বা কংগ্রেস ভবনে প্রবেশ করে। বিক্ষোভকারীরা বহু কংগ্রেসনাল অফিস তছনছ করে। কংগ্রেসম্যান ও অন্যান্য প্রতিনিধি নিরাপত্তার জন্য পালাতে বাধ্য হন। ২০২১ সালে প্রকাশিত বাইপার্টিজান সিনেট রিপোর্টে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় তিনজন পুলিশ অফিসারসহ সাত ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দাঙ্গার উসকানিদাতা হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়। এক মাস পর সিনেট তার বিরুদ্ধে প্রতিনিধি পরিষদে আনীত অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়।
সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব রাজনৈতিক উচ্চ পদাধিকারীকে হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মিশিগানের ডেমোক্রেট গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার। ২০২০ সালের অক্টোবরে একদল লোক, যারা নিজেদের ‘মিলিশিয়া’ বলে দাবি করত, তারা গভর্নর গ্রেচেনকে অপহরণ এবং রাজ্য সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এফবিআইর তদন্তকারীরা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, দলটির কিছু সদস্য ‘স্বেচ্ছাচারীকে’ হত্যা অথবা ‘গভর্নরকে তুলে নেওয়ার’ বিষয়ে আলোচনা করেছে। এছাড়া তারা তাদের দলের জনশক্তি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ ঘটনায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে লুইজিয়ানার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্টিভ স্ক্যালিজকে ভার্জিনিয়ায় বেসবল প্র্যাকটিস করার সময় গুলি করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যিনি গুলি ছুড়েছিলেন, তিনি ৬৬ বছর বয়সি এক বৃদ্ধ, ইলিনয় রাজ্যের বাসিন্দা। এ ঘটনায় আরও চার ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের গুলিতে হত্যা চেষ্টাকারী বৃদ্ধ নিহত হন। কংগ্রেসম্যান স্ক্যালিজের আঘাত এত গুরুতর ছিল যে, তার নয়টি সার্জারির পর তিন মাসের অধিক সময় তাকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। বন্দুকধারী হজকিনসন কট্টর রিপাবলিকান-বিদ্বেষী ছিলেন এবং ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার রিপাবলিকান-বিদ্বেষ এত বৃদ্ধি পায় যে, তিনি অনলাইন পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রতারক হিসাবে উল্লেখ করে লেখেন, ‘ট্রাম্প অ্যান্ড কোম্পানিকে ধ্বংস করার এখনই সময়।’
কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে যে রাজনৈতিক সহিংসতামূলক ঘটনা ঘটে চলেছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর পেছনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদসুলভ কথামালার রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। তিনি সহিংস ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন ২০১৫ সাল থেকে। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা, ইমিগ্রান্ট কমিউনিটি, বিভিন্ন মুসলিম দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় আপত্তিকর মন্তব্য করে তার সমর্থকদের উসকানি দেন। সমর্থকরাও লুফে নেয় তার বাগাড়ম্বর। তিনি তার প্রতিটি সমাবেশ, প্রতিটি টুইট, প্রতিটি ইন্টারভিউকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পরীক্ষাগার হিসাবে ব্যবহার করেন। রাজনীতিকে তিনি অপরাধ সংঘটনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র ৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে। তার দায়িত্বকালের আরও সাড়ে ৩ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা কোথায় দাঁড়াবে, তা ভেবে আমেরিকানরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক ও অনুবাদক
