জন্ম নিচ্ছে হিংসাত্মক এক নতুন পৃথিবী
জোনাথন কুক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ইরানের ওপর ইসরাইলের সুস্পষ্ট আগ্রাসনকে এক ধরনের ‘প্রতিরক্ষামূলক’ পদক্ষেপ হিসাবে উপস্থাপনের অসম্ভব চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। যদিও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলিদের ওপর হামাসের একদিনের আক্রমণের পালটা জবাবের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার মতো সুযোগ এবার তাদের ছিল না। তেল আবিব এবার হামলার অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আগে থেকেই কোনো নাটকীয় কল্পকাহিনি তৈরি করতে পারেনি, যেমনটা ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন অন্যায়ভাবে ইরাকে আক্রমণের জন্য করেছিল। সেবার আমাদের বলা হয়েছিল, বাগদাদের কাছে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ রয়েছে, যা তারা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ইউরোপে নিক্ষেপ করতে সক্ষম। বরং, গত ১৩ জুন যখন ইসরাইল বিনা প্ররোচনায় ইরানে আক্রমণ শুরু করে, তখন তেহরান তার পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৯২ সাল থেকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই ‘ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে’ বলে যে দাবি করে আসছেন, খোদ পশ্চিমারাই এখন তা প্রত্যাখ্যান করছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছানোর আশা প্রকাশ করার পরপরই এবং দুই দেশের আলোচকদের আবার দেখা হওয়ার দুই দিন আগে ইসরাইল বিনা প্ররোচনায় ইরানে হামলা চালায়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এ যুদ্ধ আত্মরক্ষার জন্য নয়, এটি আগ্রাসন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বর্তমানে যে আলোচনা চলছিল, তার প্রয়োজন ছিল। কারণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ইসরাইলের তীব্র চাপের মুখে তেহরানের সঙ্গে বিদ্যমান একটি চুক্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। তার পূর্বসূরি বারাক ওবামার সময় করা ওই চুক্তিটি ইরানের ওপর হামলার জন্য ইসরাইলের অবিরাম আহ্বানকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। সেই চুক্তি তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে কঠোরভাবে সীমিত করেছিল। কিন্তু ইরানকে চাপ দেওয়ার বিপরীতে ইসরাইলকে কমপক্ষে ১০০টি ওয়ারহেডের পারমাণবিক অস্ত্রাগার রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তুলনা করলে দেখা যায়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও ইসরাইল তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এমনকি ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার নিরীক্ষকদের প্রদেশে অনুমতি দিলেও ইসরাইল তা দেয়নি।
পশ্চিমাদের যোগসাজশে ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র গোপন রাখার এ মনোভাব শুধু এ কারণেই প্রয়োজন হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র অঘোষিত পারমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রটিকে সামরিক সহায়তা প্রদানের অনুমতি দেয় না। যদিও ইসরাইল এখন পর্যন্ত এ ধরনের সাহায্যের সবচেয়ে বড় গ্রহীতা। বর্ণবাদীরা ছাড়া কেউই বিশ্বাস করে না, ইরান ইসরাইলে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেবে, এমনকি যদি তাদের কাছে তা থেকে থাকেও। প্রকৃতপক্ষে এটি ইসরাইলি বা মার্কিন উদ্বেগের আসল কারণ নয়। বরং, এর মাধ্যমে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসাবে রাখার জন্য দ্বিমুখী নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, যাতে এটি তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে অবাধ সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারে, যা পশ্চিমারা নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর।
ইসরাইলের এ বোমা হামলা দেশটিকে অস্পৃশ্য এবং জবাবদিহির অযোগ্য করে তুলেছে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভির সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে ঠিক এমনই এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসবে, সর্বদা হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা মনে রাখবেন। তিনি আরও বলেছেন, মনে রাখবেন, ইসরাইলি সরকারগুলো তাদের বর্তমান অবস্থানের জন্য যে কোনো হুমকিকে ‘অস্তিত্বগত’ হিসাবে বিবেচনা করে। ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র এটি নিশ্চিত করে যে, তারা প্রতিশোধের উদ্বেগ ছাড়াই-গাজায় গণহত্যাসহ-যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে।
ইরানে হামলা চালিয়ে ইসরাইল ‘নিজেকে সুরক্ষা দিচ্ছে’-এই দাবি, যা ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি৭ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচার করছে-তা যে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতির ওপর আরও এক ধাপ আক্রমণ, তা বোঝা উচিত। এই দাবির ভিত্তি হলো, ইসরাইলের হামলা ‘প্রতিকারমূলক’ ছিল। তবে এই দাবি তখনই সঠিক হবে, যদি ইসরাইল প্রমাণ করতে পারে যে, ইরান থেকে একটি তাৎক্ষণিক, বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুতর হামলা বা আগ্রাসনের হুমকি ছিল, যা অন্য কোনো উপায়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। এমনকি যদি ধরাও হয়, ইসরাইলের দাবি সমর্থনে প্রমাণ রয়েছে, তারা তাৎক্ষণিক বিপদে ছিল (যদিও আসলে তা নেই), তখনো সেই যুক্তি খাটে না, কারণ ইরান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছিল।
বরং, প্রতিরোধী যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করাতে ‘ইরান ভবিষ্যতে কোনো সময়ে হুমকির কারণ হবে, তাই সেটি নিরসন করা প্রয়োজন ছিল,’ ইসরাইলের এমন দাবিও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে নিঃসন্দেহে অবৈধ বলে গণ্য হবে। মাত্র তিন বছর আগে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার তথাকথিত ‘বিনা প্ররোচনায়’ আক্রমণের প্রতি পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এটি একটি দৃশ্যমান বৈপরীত্য। তখন পশ্চিমা দেশ ও তাদের মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া হিসাবে খুব স্পষ্ট বার্তা ছিল, মস্কোর এমন কার্যকলাপ নৈতিকভাবে অযৌক্তিক এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়াই একমাত্র সঠিক পথ। তারা এ ব্যাপারে এতটাই কঠোর ছিল যে, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে রুশ বাহিনী প্রত্যাহারের ভিত্তিতে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রাথমিক প্রচেষ্টাতেও সম্ভবত ওয়াশিংটনের নির্দেশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বাদ সেধেছিলেন। ফলস্বরূপ, ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইনের আরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নেতানিয়াহু, যিনি ইতোমধ্যেই গাজার জনগণকে অনাহারে রেখে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পলাতক রয়েছেন, তিনি এখন ‘সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধে’র দোষেও দুষ্ট। কিন্তু কোনো পশ্চিমা রাজনীতিবিদ বা বিলিয়নিয়ার মালিকানাধীন মিডিয়া থেকে এ তথ্য কেউ জানতে পারবে না। বরং সেখানে ইসরাইলকে সাহসী হিসাবে বর্ণনা করা হয়। বলা হয়, ইসরাইল অস্তিত্বের হুমকির মুখোমুখি; ইসরাইল বর্বর সন্ত্রাসীদের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন; ইসরাইলের মানুষ বিশেষ কষ্টে আছে এবং নেতানিয়াহুকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসাবে প্রচার করা হয়, যুদ্ধাপরাধী হিসাবে নয়। অর্থাৎ সেই একই পুরোনো স্ক্রিপ্ট, যা প্রতিটি অনুষ্ঠানেই প্রচার করা হয়েছে। ঘটনা বা পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, এটি যথেষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, পশ্চিমের মানুষকে প্রকৃত সত্যটা অবহিত করা হচ্ছে না।
ইরানের ধ্বংসের পথ পরিষ্কার করার আগে ইসরাইলকে হামাস, হিজবুল্লাহ ও সিরিয়াকে নির্মূল করতে হয়েছিল। আশঙ্কা থেকেই যায়, ইরানে আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিরোধ অক্ষকে নির্মূল করতে হবে। পাশাপাশি রাশিয়াকে ইউক্রেনে অনির্দিষ্টকালের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় আটকে রাখতে হবে, তারপরই তারা চীনকে মোকাবিলা করার কথা ভাবতে পারবে। এটি পেন্টাগনের ২০ বছরব্যাপী পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা ‘গ্লোবাল ফুল-স্পেকট্রাম ডমিন্যান্স’ নামে পরিচিত : যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে থাকবে। এমন একটি বিশ্বে-যেখানে একটি ছোট, অজবাবদিহি এলিট, যাদের যুদ্ধ থেকে লাভ হয়েছে, তারা বাকি সবাইকে শর্তের বেড়াজালে রাখবে।
আসলে বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দায়মুক্তি আমাদের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এ যন্ত্রণাদায়ক জন্মক্রন্দন এখন আরও বাড়বে। আপনি যদি মানবাধিকারে, সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায়, সামরিক আগ্রাসনের আগে কূটনীতির ব্যবহারে, আপনার বেড়ে ওঠার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে নতুন যে পৃথিবী জন্ম নিচ্ছে, তা আপনাকে আতঙ্কিত করবে।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তরিত
জোনাথন কুক : ইসরাইলি-ফিলিস্তিন সংঘাত বিষয়ক লেখক, সাংবাদিকতায় মার্থা গেলহর্ন বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত
