Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গণতন্ত্র বাঁচলে মিডিয়াও বাঁচবে

Icon

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণতন্ত্র বাঁচলে মিডিয়াও বাঁচবে

গত ১৬ জুন ছিল সংবাদপত্রের কালো দিবস। ১৯৭৫ সালের এ দিনে বাকশাল সরকার ব্যক্তি মালিকানাধীন সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৬ সাল থেকে তৎকালীন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দিবসকে কালো দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে যুক্ত হলেও মূল বিষয়টি রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকায় দিবসটির তাৎপর্য অনেক বেশি ও গুরুত্ববহ। ফ্যাসিবাদমুক্ত আবহে এবারে যখন দিবসটি পালিত হলো সেই সময়ে দেশে গণতন্ত্রের বড় শরিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক মন্তব্যে বলেছেন, গণতন্ত্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, বিগত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর গণমাধ্যম কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করলেও এখনো ফ্যাসিবাদ শক্তির হাত থেকে গণমাধ্যম পুরোপুরি মুক্ত নয়।

মিডিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের দর্পণ। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা যেহেতু পরস্পরের হাত ধরে চলে তাই দুটো বিষয় নিয়েই ভাববার রয়েছে। নীতিগত দিক থেকে আওয়ামী লীগ কোনো বামপন্থি দল ছিল না। সাধারণত মনে করা হয়, বাম রাজনীতির সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার একটি বিষয় থাকে। যদিও এ আলোচনা পুরোনো। কারণ সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বামপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বামপন্থি সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সময়ে সেখানে মতপ্রকাশের মাধ্যমের ওপর কোনো আঘাত আসেনি। তাহলে বাংলাদেশে এ ব্যতিক্রম কেন? গত ৫৩ বছর বিশেষ করে গত সাড়ে ১৫ বছরের আলোকে এ বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে মুখর দৈনিক ছিল গণকণ্ঠ। তার সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। সরকারি লুটপাট, সন্ত্রাস, ব্যভিচার আর অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ কাগজটি বন্ধ করতে সরকার কুখ্যাত আইয়ুবী আইনের প্রয়োগ করেছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই। মনে করুন স্বাধীনতার পর প্রথম একুশ পালনের কথা। বাতি নিভিয়ে গভীর রাতে শহীদ মিনারে ওই রাতে যা হয়েছিল তার বিবরণ রয়েছে সে সময়ের গণকণ্ঠে। গণতন্ত্রকে তছনছ করে যে দুর্বৃত্তায়ন গোটা জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল তার সঙ্গে গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষার কোনো সংগতি ছিল না। এই না থাকাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এত দ্রুততম সময়ে ভূলুণ্ঠিত হবে, পদদলিত হবে সেটি হয়তো কারও অনুমানের মধ্যেও ছিল না। সন্ত্রাস দমনের নামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের আশকারা প্রদানের এক মারাত্মক আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছিল সরকারি প্রশাসন যন্ত্র। এ খেলার সূত্রপাত কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী সরকারের যে গোপন আঁতাত ছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এসব কাজে। সে সময়ের চিত্র বোঝাতে গত আওয়ামী আমলের শাসন থেকে একটু তুলে ধরা যাক। বিগত সময়ে দেশ থেকে ভারত বিরোধিতা নিশ্চিহ্ন করতে কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে ভারতীয় তাঁবেদারি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, দেশকে ভারতের করতলগত করতে শুধু একটি ঘোষণাই বাকি ছিল। উন্মুক্ত সীমান্ত, সীমান্তে বিনাবিচারে বাংলাদেশি হত্যা, অভ্যন্তরে ভারতীয়দের অবাধ বসবাস, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অফিস সব মিলে দেশটা ভারতীয়দের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। এ দুঃসময় হঠাৎ করে আসেনি। একটি পরিকল্পিত নীলনকশার মাধ্যমে অনিবার্য করে তোলা হয়েছিল। এ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। অথচ তখনকার মিডিয়ার অবস্থা কী ছিল? একদিকে বেছে বেছে মিডিয়া থেকে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের নানা ছলছুতায় চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, মিডিয়াগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি চাটুকার মোসাহেব দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে তোষামোদির পাত্র। গণভবনে দেখা যেত এসব চাটুকারের যেন কর্তার চেয়ে মাঝির জোর বেশি। নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করে সাংবাদিকদের মানমর্যাদার প্রতিষ্ঠানগুলোও তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন যারা ১৯৭৫ সালে বাকশালের বিরোধিতা করেছিলেন এবং কুরবানির পশুর মতো ট্রাকে করে বাকশালে যোগদানে বিরত থেকেছেন। এ বিষয়টি দেখার মতো।

বাংলাদেশে মিডিয়াবান্ধব ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এ দুই সময় ছিল মিডিয়ার স্বর্ণযুগ। প্রেসিডেন্ট জিয়া মনে করতেন জনগণকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা সম্ভব নয়। সেজন্য তিনি মিডিয়া এবং সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের খুব ভালোবাসতেন। আর বেগম জিয়ার আমলে মিডিয়ার ওপর কোনো হস্তক্ষেপই করা হয়নি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মিডিয়া দুর্বৃত্তের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কারণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নিগড়ে গোটা জাতি আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কেন এমন হতে পেরেছিল সেটি বোঝা আজ সংবাদপত্রের তথা গণতন্ত্রের পথচলা নির্বিঘ্ন করতে খুব বেশি জরুরি বিষয়। ফ্যাসিবাদ বলতে শুধু একটি দলকে বোঝায় তা নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া, মানসিকতা। কারও উথলে উঠলেই বিপদ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও মূলত এ মানসিকতা ও বাস্তবতার পরিবর্তন হয়েছে সেটি বলা যাবে না। সাংবাদিকদের আলোচনা সভায় একজন বললেন, পরিবর্তনের সোল এজেন্ট দাবিদার কোনো কোনো মহল নয়া ফ্যাসিজমের পাঁয়তারা করছে। কার্যত বাংলাদেশে এখন মিডিয়ার অবস্থা খুব নাজুক। বারবার কোমর ভাঙা মিডিয়াকে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে সাংবাদিকদের জন্য আবাসনের কথা জানিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। অবারিত গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার দেশপ্রেমিকতার কোনো বিকল্প নেই। দেশ বিক্রির অশুভ চক্রান্তের হোতা আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাতে না দেশ না মিডিয়া কিছুই নিরাপদ নয়। সে কারণেই আজ দেশ রক্ষার জরুরি বিবেচনা থেকেই মিডিয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। এই যৌক্তিক গণদাবি রক্ষায় স্থায়ী করণীয় নির্ধারণের মৌলিক দায়িত্ব গণতন্ত্রের বড় শরিক বিএনপির ওপরই কার্যত বর্তায়। আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। এটাই সত্যি, গণতন্ত্র না বাঁচলে মিডিয়া বাঁচবে না। সে কারণেই মিডিয়া রক্ষার্থে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক।

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম