আগুনের লেলিহান শিখা কতটা পোড়াবে?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন, পি এস সি
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এখন সরাসরি যুদ্ধে রূপ নিয়েছে এবং গোটা বিশ্ব এক গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কারণ, এ সংঘর্ষ যে কোনো মুহূর্তে আরও বড় ও ব্যাপক যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে। এ যুদ্ধ ইতোমধ্যেই আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মাত্রায় পৌঁছে গেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে এবং বিশ্বরাজনীতিতে জোটবদ্ধতার নতুন রেখাচিত্র আঁকা হচ্ছে।
গত রাতেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি সন্দেহভাজন ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় এইট-৫৭ বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে এবং দাবি করেছে যে, তারা সফলভাবে সাইটগুলো ধ্বংস করেছে। তবে ইরান এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে-হ্যাঁ, স্থাপনাগুলোর ওপর বোমা পড়েছে, কিন্তু বাস্তবে ক্ষতি ছিল খুব সামান্য এবং পারমাণবিক কর্মসূচির কোনো মৌলিক ক্ষতি হয়নি, এমনকি কোনো বিকিরণ (radiation) ছড়ায়নি বলেও জানিয়েছে।
এ হামলার পরও ইরান আত্মরক্ষামূলক পালটা আঘাত বন্ধ করেনি। বরং উত্তরের হাইফা এবং কেন্দ্রীয় ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আরও জোরালো করেছে। মার্কিন হস্তক্ষেপ ইরানকে দমন করতে পারেনি বরং তাদের প্রতিরোধ আরও দৃঢ় হয়েছে। এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি এর আগে বলেছিলেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত জানাতে ‘দুই সপ্তাহ সময় নেবেন’, বাস্তবে মাত্র দুদিনের মধ্যেই হামলার আদেশ দেন-যা অনেকেই কৌশলগত প্রতারণা বা ‘deception plan’ হিসাবে দেখছেন।
এখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি-বিশেষ করে কুয়েত, বাহরাইন ও কাতার-লক্ষ্য করে পালটা হামলা চালাতে পারে। যদি এ আঘাত ঘটে, তবে তা শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং আরও বহু দেশ এ সংঘাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। ইতোমধ্যেই রাশিয়া, চীন ও তুরস্ক ইরানের প্রতি রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে এক বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাত থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বযুদ্ধের অবকাশ তৈরি হয়েছে।
এ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি বিশ্বের জ্বালানি পরিবহণের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। যুদ্ধ সেখানে ছড়িয়ে পড়লে তেলের সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে এবং বিশ্ববাজারে এর প্রভাব হবে তীব্র। ইতোমধ্যেই অপরিশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, পণ্য পরিবহণ ব্যয়, খাদ্য উৎপাদন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, তা এ নতুন সংকটে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
এ সংঘর্ষ শুধু রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠবে। হিজবুল্লাহ, হুতি বিদ্রোহী, ইসলামিক জিহাদ ও অন্যান্য প্রক্সি গোষ্ঠী যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে একযোগে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা জোরদার হতে পারে। এমনকি বিশ্বের অন্য প্রান্তেও ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে প্রতিশোধমূলক আঘাত চালানো হতে পারে, যেমন-সাইবার হামলা, কূটনৈতিক সম্পদের ওপর আক্রমণ বা বাণিজ্যিক স্থাপনার লক্ষ্যবস্তু তৈরি করা।
যুদ্ধের আরেকটি আশঙ্কাজনক দিক হলো সাইবার যুদ্ধ। ইরান, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র-এ তিন দেশই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাইবার যুদ্ধে দক্ষ। যদি সংঘাত সাইবার ফ্রন্টে প্রসারিত হয়, তাহলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক ও জরুরি সেবায় ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে। এটি জনমানসে আতঙ্ক, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে।
এ পরিস্থিতি এক ভয়ংকর চক্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একবার যুদ্ধের গতি শুরু হলে তা থামানো যায় না-এটি নিজের গতিতে আরও গভীরে প্রবেশ করে। যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা বা কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে বোমা বর্ষণ চালায়, তাহলে ইরান কেবল মার্কিন ঘাঁটিতেই নয়, আশপাশের মিত্র রাষ্ট্রগুলোতেও হামলা চালাতে পারে। এতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, এমনকি তুরস্ক পর্যন্ত আগুনের এ খেলায় পুড়তে পারে।
বিশ্ববাসী এখন এক কঠিন সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এটি শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি মানবতার অস্তিত্বের প্রশ্ন। যদি দ্রুত কূটনৈতিক সংযম, সত্যভিত্তিক আলোচনার পরিবেশ এবং শক্তির অহংকার ছেড়ে সহানুভূতির পথে ফিরে না যাওয়া যায়, তাহলে এ সংঘাত খুব সহজেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়েছিল একটি সামান্য হত্যা থেকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এক রাষ্ট্রের দম্ভ থেকে। তৃতীয়টি শুরু হতে পারে ভুল তথ্য, সামরিক আগ্রাসন ও জ্বালানির রাজনীতির ছায়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এবার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব, নাকি আবারও সভ্যতাকে ঠেলে দেব ধ্বংসের দিকে?
বিশ্ববাসী এখন প্রার্থনা করছে, যেন সংযম, বিবেক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রচেষ্টা জয়ী হয়-তার আগে, না ঘটে এমন এক বিপর্যয়, যার ক্ষতি পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
এইচ আর এম রোকন উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
