Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইরানের এক হামলাতেই সুর পালটে গেল ট্রাম্পের

Icon

সুব্রত বসু

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানের এক হামলাতেই সুর পালটে গেল ট্রাম্পের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ট্রাম্পের বিমান হামলার পালটা পাটকেল মেরেছে ইরান। সোমবার রাতে কাতারে আমেরিকার সেনাছাউনিতে মিসাইল হামলা চালিয়েছে তারা। আর এরপরই হাঁটু কেঁপে গেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের, যিনি কয়েক ঘণ্টা আগেই বড় বড় বুলি আউড়ে ইরানকে সবক শেখাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইরানি মিসাইল হামলার এক ঘণ্টা পরে তিনি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করে দিয়েছেন। আর মজার কথা, এবার আর প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে এসে তিনি এ ঘোষণা দেওয়ার হিম্মতও দেখাননি। নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সিজফায়ারের ঘোষণা দিয়ে আপাতত মুখ লুকিয়েছেন। তিনি কি ভাবতে পারেননি, ইরান তার সেনার ওপর পালটা আঘাত হানার স্পর্ধা দেখাতে পারবে? একেই কি বলে ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’? অপারেশন সিঁদুরের পর তার যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অম্লান বদনে মেনে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও শাহবাজ শরিফ।

মঙ্গলবার ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় খবর ছিল, কাতারে আমেরিকান সেনাছাউনিতে ইরানের মিসাইল হানা। এ খবরের গুরুত্ব নিয়ে যখন বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুরু করেছে, তখনই জানা গেল ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কোনো ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে এবার মাথাটি নত করেছেন এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন একতরফাভাবে। ইরান-ইসরাইলের যুদ্ধে খামোখা জড়িয়ে পড়ার পর ঘরে-বাইরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রীতিমতো ফেঁসে গিয়েছিলেন। ইরানের পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রের ওপর আমেরিকার বোমারু বিমানের ফেলা টনটন বারুদ যে কার্যত বিফলে গেছে, তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জেনে গিয়েছিল বিশ্বের মানুষ। আমেরিকাও এমন কোনো পোক্ত প্রমাণ দিতে পারেনি, যাতে বোঝা যায় ইরানের পরমাণুকেন্দ্রের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়েছে। ইরানের তেমন ক্ষতি না হলেও ট্রাম্পের কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে এ হামলার পরে। না, আমি শুধু আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কথা বলছি না। এমনটা যে হবে, সে তো অনেকেই জানতেন। কিন্তু যে ক্ষতিটার কথা সম্ভবত তিনি জানতেন না, সেটা হলো, আমেরিকার আকাশছোঁয়া ইগোর উপরে জবরদস্ত হামলা করার স্পর্ধা দেখাতে পারবে ইরান। তিনি ভেবেছিলেন, আমেরিকার ভয়ংকর বি-টু বিমান এবং বাংকার বাস্টারের ঘা খেয়ে নতজানু হয়ে তার পায়ে এসে পড়বে ইরান। আর তিনি অবতারের মতো নিজের শর্তে সেখানে শাসক পরিবর্তন করে দেশটাকে নিজের কবজায় নিয়ে আসবেন। কিন্তু এখন ইরানের পালটা হামলার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন, এ যুদ্ধ চালিয়ে গেলে আমেরিকানদের ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে। এমনকি আমেরিকার ফৌজের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া একজন তরুণেরও ক্ষতি হলে মার্কিনিরা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। আর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ৫ হাজারেরও বেশি সেনা এখন ইরানের মিসাইলের আওতার মধ্যে রয়েছে। তাদের বাঁচানোর ক্ষমতা কি ট্রাম্পের আছে? এর মধ্যে আবার খবর এসেছে, ইরান আমেরিকায় থাকা তাদের স্লিপার সেলগুলোকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সেখান থেকেও বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন আমেরিকানরা। এবং শুধু মুখে বড় বড় কথা বলা নয়, ইরান কিন্তু নিত্যনতুন একেকটি মিসাইল হানায় ইসরাইলের সমৃদ্ধ শহর ও বন্দরগুলোকে মোটামুটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। সেই সঙ্গে হরমুজ প্রণালিতে আধুনিক মাইন পাতার প্রস্তুতি শুরু করার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এ আশঙ্কায় এরই মধ্যে কিছু তেলবাহী ট্যাংকারের যাত্রা বাতিলও করা হয়েছে। ট্রাম্পের বিমান হানার পর আমেরিকাকে যে ছেড়ে দেওয়া হবে না, সেই হুমকি টেলিভিশনে এসে জানিয়েছিলেন খোদ খামেনি নিজেই। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হয়ে যায় কাতারে আমেরিকার সেনাছাউনিতে হানা।

ইরান জানিয়ে দিয়েছে, তাদের এ অপারেশন সফল হয়েছে। তবে পরের ধাপে কী হবে, তা নিয়ে এখন বেশি চিন্তিত ট্রাম্প প্রশাসন। আসলে দুই রাষ্ট্রের এ যুদ্ধের মধ্যে নাক গলিয়ে ট্রাম্প ভীষণরকম ফেঁসে গিয়েছেন। ইরানের মিসাইল হানায় একজন সৈন্যের মৃত্যুও এখন তাকে পথে বসিয়ে দিতে পারে। বিদেশের মাটিতে খামোখা নিজেদের দেশের সেনার মৃত্যু হওয়া এ জমানার আমেরিকান জনতা যে একেবারেই মেনে নেবে না, তার দেশের জনমত সমীক্ষায় তা জানিয়ে দিয়েছে। আর তাই মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেই যিনি দাবি করেছিলেন, আমেরিকার সেনার ওপর কোনোরকম আক্রমণ হলে ইরানকে বড়সড় শিক্ষা দেওয়া হবে, সেই তিনিই এখন ঢোক গিলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে আপাতত ঘরে ঢুকে গেছেন।

ইরান ট্রাম্পের ওই চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি ইসরাইলের দিক থেকেও তাদের নজর কিন্তু সরায়নি। এরই মধ্যে এ যুদ্ধে ইরানের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। হাজারখানেক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে তাদের মিসাইল। এর ফলে গত কয়েক ঘণ্টা ধরেই শোনা যাচ্ছিল, ইসরাইল এখন যুদ্ধবিরতির একটা সম্মানজনক পথ খুঁজছে। মানে নিজেরা আক্রমণ চালিয়ে এখন তারা চাইছে-অনেক হয়েছে বাবা, এবার থামো, খেলা শেষ।

প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যি কি থামবে যুদ্ধ? ইরান বলছে, আমেরিকা বা ইসরাইলকে বিশ্বাস করে আগেও তারা ঠকেছে। এখন তারা আর এ প্রতারণার শিকার হতে রাজি নয়। তবে আমেরিকার যে কিল খেয়ে কিল হজম করা এবং ইসরাইলের যেরকম প্রতারণার অভ্যাস আছে, ইতিহাসেই কিন্তু তার অনেক প্রমাণ আছে। এরকম একটা ঘটনার কথা বলা যাক। শুনে অবাক হবেন, ৫৮ বছর আগে আমেরিকার বন্ধু ইসরাইল বাহিনী একটি মার্কিন জাহাজ ইউএসএস লিবার্টির ওপরে হামলা করে। এ ঘটনাটি ৪ জুন ১৯৬৭ সালের। জাহাজটি মিশরের উপকূলের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমায় দাঁড়িয়েছিল। ইসরাইলি বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর টরপেডো জাহাজটির ওপর আক্রমণ চালালে ৩৪ জন মার্কিন নৌসেনা নিহত হন। আহত হন ১৭১ জন। আমেরিকা কিন্তু এ হামলার জবাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কেন? ইসরাইলের দাবি ছিল, তারা জাহাজটিকে ভুল করে মিশরীয় নৌবাহিনীর জাহাজ বলে মনে করেছিল। তবে তাদের এ দাবি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। অনেকে, বিশেষ করে জাহাজের ক্রু এবং সমর বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ইসরাইল ইচ্ছা করেই এ হামলাটি করেছিল। জাহাজের বেঁচে যাওয়া সৈন্যরাও বারবার বলেছেন, এ হামলাটি ইচ্ছাকৃত ছিল এবং ইসরাইল জেনেশুনেই আমেরিকান জাহাজে আক্রমণ করে। কেন? ওই সেনাদের দাবি ছিল, জাহাজটি এমন কিছু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিল, যা সম্ভবত ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। তাই তার ওপরই আঘাত হানে ইসরাইল। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জনসন এবং তার আধিকারিকরা ইসরাইলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের কারণে বিষয়টি চেপে গিয়েছিলেন। অনেকে বলেন, আমেরিকা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে দেয়। এটি ইসরাইল ও আমেরিকার সম্পর্কের একটি স্পর্শকাতর অধ্যায় হিসাবেই ইতিহাসে রয়ে গেছে। ৫৮ বছর আগের ঘটনাটি এখন ওঠা আমেরিকা ও ইসরাইলের বিশ্বাসযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে সামনে আনলাম। এরপরে আপনারাই বলবেন, সত্যিই কতটা বিশ্বাস করা যায় আমেরিকা এবং তার দোসর ইসরাইলকে।

‘সুব্রত বসু জার্নালিস্ট’ ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে

সুব্রত বসু : বিশ্লেষক ও সাংবাদিক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম