আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন
আবুল কাসেম হায়দার
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের ব্যাংক খাতসহ আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে ভগ্নদশায় নিমজ্জিত। বিগত সরকারের দুর্নীতি, অর্থ পাচার, লুটপাটে দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে আর্থিক খাতের কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে আরও বেশি দৃশ্যমান উন্নতি আশা করছে জাতি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতের উন্নতির জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। উন্নতিও দৃশ্যমান। তবে আরও দ্রুত উন্নতি প্রয়োজন।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এবং যাদের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি, সেগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব এনবিএফআই’র বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের যে ঋণ রয়েছে, তার বিপরীতে জামানতও খুবই কম। এ অবস্থায় এসব এনবিএফআই’র বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান একীভূত বা অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করে গেছেন, তার জের টানতে হচ্ছে পুরো খাতকে। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়। পি কে হালদার যখন এসব অনিয়ম করেন, তখন তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। পি কে হালদারের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোরও একই দশা করেন এস আলম। তাতে পুরো আর্থিক খাতই এখন ধুঁকছে।
সমস্যা কী : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র থেকে জানা যায়, দেশে মোট এনবিএফআই রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২০টির অবস্থা খুবই নাজুক। গত ডিসেম্বরে এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ১৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি আমানত ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এ ঋণের ৮৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ ২১ হাজার ৪৬২ কেটি টাকা। ঋণের বিপরীতে জামানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। জামানতের অর্থ দিয়ে ব্যক্তি আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব। সব মিলিয়ে ২০টি প্রতিষ্ঠানের ক্রম পুঞ্জিত ক্ষতির পরিমাণ ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এতে পুরো খাতের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিহ্নিত ২০টি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বছরে বেতন ১৭২ কোটি টাকা ও এমডিদের বেতন ১২ কোটি টাকা। ভাড়া, অন্য খরচসহ সব মিলিয়ে ব্যয় ২০৬ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত কোনো সুদ আয় নেই। তাই আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি আর যাতে খারাপ না হয়, এ জন্য কঠোর তদারকির মধ্যে রাখা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান চলতে পারছে না, সেগুলোর বিষয়ে সামনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে : সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে আমানতকারীর দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা, শ্রেণিকৃত ঋণের উচ্চহার, মূলধন ঘাটতি তথা ন্যূনতম সংরক্ষিতব্য মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতাসহ নানা বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী কেন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে না, জানাতে হবে।
এনবিএফআই’র ৩৩ শতাংশ ঋণই খেলাপি : গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। অবশ্য ২০টি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে পুরো খাতের খেলাপি ঋণ বেশি। ২০ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য ১৫ এনবিএফআই’র গড় খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের কম, অনেক ব্যাংকের চেয়েও এই ১৫ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অবস্থা ভালো। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি আর যাতে খারাপ না হয়, এ জন্য কঠোর তদারকির মধ্যে রাখা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান চলতে পারছে না, সেগুলোর বিষয়ে সামনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
এখন যেসব উদ্যোগ প্রয়োজন : ঢালাওভাবে সব আর্থিক খাত দুর্বল বলা যায় না। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে লুট করা হয়েছে, শুধু তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবার লাইসেন্স বাতিল করা হবে এই মর্মে চিঠি অর্থনীতিতে নেতিবাচক বার্তা বহন করে। কারণ একটি বিশেষ মহল চায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। তাতে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা হবে। সব স্তরে স্বৈরাচারদের দোসররা বসে বসে কুকাজগুলো করে যাচ্ছে।
সরকার ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করছে। ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থ সরবরাহ করে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে আর্থিক খাতকে নানা বিধিনিষেধ দিয়ে অচল করে রাখা হচ্ছে। এমনকি কোনো আমানতকারী ৫০ লাখের অধিক টাকা লিজিং কোম্পানিতে রাখতে পারবেন না। অথচ ব্যাংকে এক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই। এ সীমা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। লিজিংগুলোয় অর্থ জমা রাখতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিরুসাহিত করা হচ্ছে। এ কাজটিও ঠিক নয়। যেসব লিজিং সক্ষম ও উন্নতি করছে, তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা ও নীতি সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিপত্র লেখার ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ সব চিঠি মিডিয়ায় চলে আসে। তাতে অর্থনীতি খাতে নেগেটিভ বার্তা যায়। অশুভ শক্তি এটিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে তদারকি বাড়াতে হবে। স্বচ্ছতা জানতে হবে। ঘুস ও দুর্নীতি সব স্তর থেকে দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেসব ঋণখেলাপি ইচ্ছাকৃত প্রমাণিত হবে, তাদের বিদেশ ভ্রমণসহ নানা সুবিধা বাতিল করতে হবে। খেলাপিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। তাতেও উন্নতি হবে। খেলাপি কমে আসবে। ঋণ আদায় হবে।
আর্থিক খাতে সুশাসন খুবই প্রয়োজন। বিগত সরকার আমলে আইনের শাসন ছিল না। আইন অর্থ ছিল সরকারি দল ও দলের ব্যক্তিদের সহযোগিতা। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঠিকমতো ঋণ না পাওয়া অনেকে খেলাপি হয়েছেন। অন্যদিকে অনেক খেলাপি বিদেশে অর্থ পাচার করে দেউলিয়া হয়েছে। এদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ আদায়ে আইনি সহযোগিতা অনেক বেশি তীব্র হওয়া প্রয়োজন। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থের জন্য বিনিয়োগ করতে পারছে না, তাদের ঋণ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী লিজিং কোম্পানিগুলোকে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকা বিশেষ সুদহারে দ্রুত প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
শরীরের একটি অঙ্গ পঙ্গু রেখে যেমন শরীর সুস্থ রাখা যায় না, তেমনি আর্থিক খাতকে দুর্বল রেখে কোনোভাবেই দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি করা যাবে না।
আবুল কাসেম হায়দার : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি, সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই
aqhaider@youthgroupbd.com
