ফিলিস্তিনিরা জীবন দিয়ে বাসস্থান ধরে রাখলেও ইসরাইলিরা পালাতে মরিয়া
জোসেফ মাসাদ
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত ২০ মাস ধরে গাজায় অবরোধ, বাস্তুচ্যুতি ও গণহত্যার পরও ফিলিস্তিনিরা তাদের বাসস্থান ধরে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করে চলেছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার পরিমাণ বাড়াতে ইসরাইল ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হামলা করে তাদের হত্যা করছে। এরপরও নিরীহ ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অন্যদিকে ইসরাইলের সাম্প্রতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধের কারণে বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ থেকে ইসরাইলিদের দেশত্যাগ শুরু হয়েছে। ইসরাইলি নাগরিক, দ্বৈত নাগরিক এবং পর্যটকরা পালানোর জন্য ‘ফ্লোটিলা’ এবং উদ্ধারকারী ‘বিমান’ ব্যবহার করে দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ গত দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় পরিস্থিতি আরও বেশি বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। এদিকে বিপুলসংখ্যক ইসরাইলি নাগরিক পালাতে মরিয়া হয়ে ওঠায় নেতানিয়াহু সরকার তাদের দেশ ছেড়ে যেতে কার্যকরভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সর্বশেষ যুদ্ধের সময় যারা বিদেশে আটকা পড়েছিল, তাদের ফিরে আসা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলিদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলি সংবাদপত্র ‘মারিভ’ গত নির্বাচনের পর ইসরাইলিদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সহজ করার লক্ষ্যে একটি নতুন আন্দোলনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলিদের দেশত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। ইহুদিবাদী প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার ভয়ে একসঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এ দলটি তাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার ইসরাইলির স্থানান্তরের কথা বলেছিল। এ দলের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন নেতানিয়াহুবিরোধী কর্মী ইয়ানিভ গোরেলিক এবং ইসরাইলি-আমেরিকান ব্যবসায়ী মোর্দেচাই কাহানা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ইসরাইলিদের রোমানিয়া বা গ্রিসে অভিবাসন নিয়ে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করা অনেক সহজ হবে। তিনি আরও বলেন, ‘নিউ জার্সিতে আমার একটি বিশাল খামার আছে এবং আমি ইসরাইলিদের খামার ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। মার্কিন সরকারের উচিত প্রত্যেক ইসরাইলি, যাদের একটি কোম্পানি আছে অথবা যারা যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার ও পাইলটের মতো কাঙ্ক্ষিত পেশায় আছে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের সুযোগ দেওয়া।’
বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক হতাশা, ইহুদি-সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসন হারানোর ভয় এবং ইহুদিবাদী প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার কারণে ইসরাইলে বসতি স্থাপনকারী বিপুলসংখ্যক ইহুদি উপনিবেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে এক নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, ২০০৩ সালের শেষ নাগাদ ইসরাইলি সরকার অনুমান করেছিল সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি ইসরাইলি দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, যাদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আনুমানিক ৬ থেকে সাড়ে ৭ লাখ ইসরাইলির মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজারই ছিল ইসরাইলি বংশোদ্ভূত ইহুদি (অর্থাৎ ইসরাইলে বসবাসকারী ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সন্তান)। ইসরাইল সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৭ লাখ ২০ হাজার ইসরাইলি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং আর কখনো ফিরে আসেনি।
২০১৬ সালের মধ্যে ইসরাইলে অভিবাসীদের আকৃষ্ট করার এবং দেশে রাখার জন্য ইসরাইল এবং ইহুদিবাদী গোষ্ঠীগুলোর তীব্র প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আনুমানিক ৩০ শতাংশ ফরাসি ইহুদি ফ্রান্সে ফিরে গেছে। ২০১১ সালে ইসরাইলের অভিবাসী মন্ত্রণালয় ইসরাইলি অভিবাসীদের ফিরে আসার জন্য অপরাধবোধে ভুগে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে। যেমন মোমেন্ট ম্যাগাজিনের একটি বিজ্ঞাপনের বর্ণনা ছিল এমন : একটি ছোট ছেলে, নিজের আঁকা ছবিতে রং করা শেষ করে তার বাবার কাছে ফিরে আসে; কিন্তু ছেলেটির বাবাকে একটি ইজিচেয়ারে ঘুমাতে দেখা যায়, বুকে তার ইকোনমিস্ট পত্রিকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছেলেটি বাবা-বাবা বলে ডাকলেও কোনো লাভ হয়নি। একটু বিরতি দিয়ে সে আবার চেষ্টা করে। এবার ফিসফিসিয়ে : ‘বাবা?’ বলতেই এ সময় তার চোখ খুলে যায়। বাবা ছেলের ছবির প্রশংসা করে স্নেহমাখা হাত দিয়ে ছেলের চুল নেড়েচেড়ে দেয়। দৃশ্যপট বদলে যায় এবং একজন কথক হিব্রু ভাষায় বলেন : ‘তারা সর্বদা ইসরাইলে থাকবে। তাদের সন্তানরা এভাবেই ছবি আঁকবে। তাদের দেশে থাকতে সাহায্য করুন।’
বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়েছিল। কারণ এতে বলা হয়েছিল, আমেরিকা একজন প্রকৃত ইহুদির স্থান নয় এবং যে ইহুদি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তাকে ইসরাইলে বসবাস করা উচিত। এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে সাবেক ইসরাইলি কারারক্ষী ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদিক জেফ্রি গোল্ডবার্গ ‘প্রাচীন’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। বিজ্ঞাপনটি পরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং মন্ত্রণালয় ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল।
এদিকে গাজায় যখন ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলের অস্ত্র হিসাবে অনাহারকে ব্যবহার করা অব্যাহত রেখেছে, তখন এ মাসের শুরুতে প্রকাশিত হারেটজের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের পরও অধিকাংশ ফিলিস্তিনি তাদের বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছায় দৃঢ় ছিলেন। অপরদিকে একই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চলমান যুদ্ধের প্রথম দিকের তুলনায় এখন তিনগুণ বেশি তরুণ ইসরাইল ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক। যেমনটি বলা হয়েছে : ‘যুদ্ধ হলো দ্বিমুখী দানব। ইসরাইলিরা গাজাবাসীর মতো কষ্ট পাচ্ছে না, তবুও অধিকসংখ্যক ইহুদি এখানে থাকতে পছন্দ করছেন না।’ তবুও ইসরাইল সরকার যখন তার নাগরিকদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে, তখন ইসরাইলি মুভমেন্ট ফর কোয়ালিটি গভর্নমেন্ট মন্ত্রিসভায় বহির্গমনের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অস্বচ্ছ মানদণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দলটি ইসরাইলের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেছে, ইসরাইল ছেড়ে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের মৌলিক আইনের লঙ্ঘন।
হাস্যকর যে, ১৯৭০-এর দশকে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা ইহুদিদের অভিবাসনে আকর্ষণ করার জন্য একটি প্রচারাভিযান শুরু করে, তখন তারা সোভিয়েত ইহুদিদের জন্য বিশেষ অভিবাসন অনুমতি দাবি করে, যা অন্যান্য সোভিয়েত নাগরিকের জন্য অস্বীকার করা হয়েছিল। ইউএসএসআরের প্রতি ইসরাইলের চাঞ্চল্যকর আহ্বান ছিল : ‘আমার লোকদের যেতে দাও,’ যা ছিল ফেরাউনের প্রতি বাইবেলের আবেদনের প্রতিধ্বনি। আজ মনে হচ্ছে, হাজার হাজার ইসরাইলি ইহুদি অনুনয় করছে : ‘নেতানিয়াহু, আমার লোকদের যেতে দাও।’
মিডলইস্ট আই থেকে ভাষান্তরিত
জোসেফ মাসাদ : নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক আরব রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের অধ্যাপক
