Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নগর সম্প্রসারণে প্রয়োজন জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা

Icon

ফারজানা ববি

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নগর সম্প্রসারণে প্রয়োজন জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা

বহুবিধ টানাপোড়েন, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ নামক এ স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত নগরায়িত দেশের মধ্যে অন্যতম। উর্বর ভূমি এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণে এখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল কয়েক হাজার বছর আগে; পুন্ড্র নগর তার অন্যতম উদাহরণ। ধারণা করা হয়, জলপথে সহজে যোগাযোগ করা যেত বলে এ উপমহাদেশে নগর এবং সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল বহু আগে।

১৬১০ সালে মোগল সুবেদার ইসলাম খানের বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থাপনের মাধ্যমে এ নগরীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। মোগল পরিকল্পনার লক্ষণীয় স্থান হলো, সুরম্য প্রাসাদের চারপাশে উন্মুক্ত স্থান ও সুশোভিত ফুলের বাগান যেমন লালবাগ কেল্লা। তবে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মানুষ যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত মাইগ্রেট করত, তার শুরুটা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামল থেকে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ছিল প্রাদেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হচ্ছে ১৯৫৯ সালে ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের মাধ্যমে ঢাকা মহাপরিকল্পনা।

বাংলাদেশ ছিল জনসমুদ্রের দেশ, এখন জনসম্পদের দেশে রূান্তরিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছে; কিন্তু স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার ৫০ বছর পর এসে আমরা যা হারিয়েছি, তার পরিসংখ্যানও কোনো অংশে কম নয়। যেমন-নগরীর প্রাকৃতিক নৈসর্গ, প্রবহমান বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ আরও অনেক প্রমত্তা নদী এবং খাল-বিল ইত্যাদি। সর্বোপরি রাজধানী ঢাকা শহর বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরীর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

নগরীতে বসবাসরত মানুষের সবুজ ছুঁয়ে দেখার সুযোগ নেই বললেই চলে; বিনোদনের স্থান দখল করছে নানা ধরনের গ্যাজেট। বিনোদনের কথা বাদই দিলাম, মফস্বল থেকে একজন মানুষ তার স্বীয় প্রয়োজনে মহানগরীতে এলে তার রাত যাপনের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ এ নগর। শুধু ঢাকা মহানগরী কেন, পুরো বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ। অগ্রসরমান অর্থনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে, জনশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে এ রকম বিষয় বিবেচনা করে টেকসই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে বড় বড় শহর ও নগর ঘিরে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে, কর্মসংস্থান সুষ্টি হচ্ছে; তাই উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায় মানুষ দলবেঁধে শহরে ছুটে আসছে। আর নগরীগুলো এক চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, যেখানে মানুষ যা খেটে-খুটে আয় করছে, তা তাদের জীবনযাপন ব্যয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটু ভালো থাকার জন্য মানুষ রাত-দিন পরিশ্রম করছে, পরিণত হচ্ছে নগরদাসে আর নগরগুলো পরিণত হচ্ছে মানবতাবোধহীন ইট, কাঠ আর পাথরের এক জঙ্গলে।

নগরায়ণ মূলত একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া। এর ফলে গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে শহরায়নের অর্থাৎ শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হয়, কৃষিজমি কমে যায়, কৃষিজীবীরা অন্য পেশা গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর দ্রুতগতিতে এ নগরায়ণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিবছর দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ গ্রাম থেকে নগরে আসছে। গ্রামেও নগরায়ণের হাওয়া লেগেছে। গ্রাম ও মফস্বল এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা, সড়ক অবকাঠামো, সমাজ, সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নগরায়ণের ফলে মফস্বল এলাকায়ও যত্রতত্রভাবে তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি। পাঁচ-সাত ফুট সড়ক সামনে রেখে গড়ে উঠছে আট-দশতলা ভবন, যেখানে পরিকল্পনার লেশমাত্র নেই।

প্রতিবছর কী হারে বাংলাদেশ নগরায়িত হচ্ছে, তার কি কোনো পরিসংখান হচ্ছে? একটি দেশের প্রতিটি শহর তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বেড়ে উঠবে এবং শহরগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপিত হবে, তা কি হচ্ছে? মূলত ঢাকা মহানগরী, উপজেলা, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনকেন্দ্রিক অনেক ধরনের পরিকল্পনা, নীতিগত পরিকল্পনা দেখা যায়; কিন্তু জেলা বা অঞ্চলভিত্তিক কোনো ধরনের পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। একটি দেশের টেকসই নগর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হলো জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা, যা এযাবৎকাল পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল; যার মূল লক্ষ্য হতে পারত জেলাভিত্তিক আন্তঃসম্পর্কীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের জনসংখ্যা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি। বাংলাদেশে কার্যত পরিকল্পিত বিকেন্দ্রিকরণ না থাকলেও প্রশাসনিকভাবে নামমাত্র বিকেন্দ্রিকরণ রয়েছে, যা বিকেন্দ্রিকরণের উদ্দেশ্য অর্থাৎ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পুরোপুরি ব্যর্থ।

যেহেতু দেশের প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়নে সড়ক উন্নয়ন, বিদ্যুতায়ন এবং নগর সম্প্রারণ হচ্ছে, তাই প্রথমে দরকার জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা। এরপর সব জেলাকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে আঞ্চলিক স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, যার লক্ষ্য হবে জেলাভিত্তিক সম্পদের সুষম বণ্টন, আঞ্চলিক অর্থনীতির উন্নয়ন ও পরিকল্পিত নগরায়ণ, যাতে সবাই নিজ এলাকায় যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে নিতে পারে, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ থেকে বড় শহরগুলো মুক্ত হয়ে বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

আশা করি, সরকার খুব দ্রুত অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে; একই সঙ্গে নগরগুলো হবে বসবাসের উপযুক্ত।

ফারজানা ববি : নগর পরিকল্পনাবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম