যে কারণে ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বয়ান ব্যর্থ হলো
আহমদ ইবসাইস
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কিছুদিন আগেই মার্কিন যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশসীমা অতিক্রম করে ১৪টি বিশাল বোমা ফেলে। যদিও এ উসকানিমূলক হামলার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি; এ হামলাটি হয় ইসরাইলের অবৈধ আগ্রাসনের পরে, যা অন্তত ৬০০ ইরানির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সেই রাতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দুই সচিবকে পাশে নিয়ে বিশ্বকে বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দালাল ইরানকে এখন শান্তি স্থাপন করতেই হবে। বোমাগুলোকে কূটনীতির ভাষায় কীভাবে নামকরণ করা হয় এবং ধ্বংসকে স্থিতিশীলতার পোশাকে সজ্জিত করা হয়, সে সম্পর্কে কিছু ভীতিকর বিষয় রয়েছে। এ শান্তিকে কেবল ভুল নামকরণ করা হয়নি; এটি একটি অপরাধমূলক বিকৃতি। কিন্তু পাশ্চাত্যের কাছে নতি স্বীকার না করলে এ পৃথিবীতে শান্তি কোথায়?
ইরানের ওপর ইসরাইলের বেআইনি আক্রমণের ১২ দিনের মধ্যে ধ্বংসাবশেষ থেকে টেনে আনা ইরানি শিশুদের ছবি পশ্চিমা মিডিয়ার প্রথম পৃষ্ঠায় দেখা যায়নি। সে জায়গায় সুরক্ষিত বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা ইসরাইলিদের সম্পর্কে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। পশ্চিমা মিডিয়া, যারা মুছে ফেলার ভাষায় দক্ষ, তারা কেবল যুদ্ধের বর্ণনাই প্রচার করে। কেবল ইরানের বিষয়ে প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদিকে, গত ২০ মাস ধরে গাজার মানুষ যে অনাহারে মারা পড়েছে এবং তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, সে প্রচারের আলো পাচ্ছে না। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলি অভিযানে এ পর্যন্ত ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা লাখ লাখ। গাজার প্রতিটি হাসপাতাল বোমা হামলার শিকার হয়েছে। অধিকাংশ স্কুল হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, গাজায় ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে; কিন্তু তবুও পশ্চিমের অধিকাংশ মিডিয়া এ শব্দটি উচ্চারণ করবে না। উপস্থাপক এবং সম্পাদকরা সক্রিয় কণ্ঠে ইসরাইলের অবিরাম সহিংসতা স্বীকার না করে যে কোনো কিছু করতে চাইবেন।
যুদ্ধাপরাধের বিস্তারিত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিষয়ে কোনো মিডিয়া নিন্দা কিংবা সমালোচনা করবে না। ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের ‘মানবঢাল’ হিসাবে ব্যবহার করলেও কোনো মিডিয়ায় এ সম্পর্কে অভিযোগ নেই। ইসরাইলি সেনাবাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত গাজার গণহত্যার মিথ্যা বিবৃতি দিতে গিয়ে ধরা পড়লেও তা আমলে নেওয়া হয় না। বরং সেগুলোকেই সত্য হিসাবে প্রচার করা হয়।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরাইলিদের মৃত্যুর খবর ৩৩ গুণ বেশি দেখিয়েছে। এ ধরনের পক্ষপাত ব্যতিক্রম নয়, এটিই পশ্চিমা মিডিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম। পশ্চিমা গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনের মতো ইরানকেও সাবধানে বাছাই করা ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। ইরানকে কখনো একটি জাতি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়নি, বরং তাদের কেবল একটি শাসনব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের ভাষায় ইরান দেশ নয়, বরং একটি হুমকি। এখানকার জনগণ মানুষ নয়, বরং একটি সমস্যা। প্রতিটি প্রতিবেদনে ‘ইসলামিক’ শব্দটি একটি অপবাদের মতো সংযুক্ত করা হয়েছে। এটি নীরবে ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রতিরোধকে নির্মূল করতে হবে।
ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নেই; কিন্তু ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তা আছে। তবুও বরাবর ইরানকে বিশ্বব্যবস্থার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, ইরানের কাছে কী আছে তা সমস্যা নয়, তারা যে পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে, এটাই বড় সমস্যা। ইরানের মানুষ অভ্যুত্থান, নিষেধাজ্ঞা, হত্যা এবং নাশকতার মতো ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে আছে। তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের মাধ্যমে জোরপূর্বক আত্মসমর্পণের প্রতিটি প্রচেষ্টার পরও ইরানের মানুষ বেঁচে আছে। ইরান এমন একটি রাষ্ট্র, যার ওপর নানা চাপ প্রয়োগের পরও ভেঙে যায়নি। আর তাই ইরানের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হুমকির মিথ প্রয়োগ তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ইরাকে অবৈধ আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ঠিক একই মিথ ব্যবহার করা হয়েছিল। তিন দশক ধরে আমেরিকার গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো ফিসফিস করে বলেছে, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি থেকে মাত্র ‘সপ্তাহ দূরে’, তিন দশক ধরে এটি বলা হয়ে আসছে, যার সময়সীমা কখনো ফুরিয়ে যায় না। এটি এমন এক ভবিষ্যদ্বাণী, যা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি; কিন্তু ভিত্তিহীন হলেও পশ্চিমা জনগণের মনে ভয় ধরাতে এ দাবি বেশ কার্যকর। আপনি যদি মানুষকে ভয় দেখাতে পারেন, আপনি তাদের চুপ করিয়ে রাখতে পারেন। এটি পশ্চিমা মিডিয়ার মোডাস অপারেন্ডি: যে মিডিয়া সত্যকে আলোকিত করার জন্য তৈরি করা হয়নি, বরং সহিংসতার অনুমতি তৈরি করার জন্য, প্রযুক্তিগত ভাষা এবং অ্যানিমেটেড গ্রাফিক্সে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনকে সাজাতে, জনসাধারণের সামনে সত্যকে আড়াল করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন তেহরান বা রাফা থেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে নিরীহ মানুষের চূর্ণবিচূর্ণ হাড় নিয়ে লেখে না, বরং তারা ‘দ্য নিউ মিডল ইস্ট’ নিয়ে লেখে। যার প্রচ্ছদটি ২২ বছর আগে ইরাকে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রচারণার মতোই আকর্ষণীয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলি রাজনৈতিক অভিজাতদের অনেকের মতো ট্রাম্পও যুদ্ধ পরিচালনা করার সময় নিজেকে শান্তির দূত হিসাবে দাবি করতে চান। তার মতো নেতাদের কাছে শান্তির অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা জানি, শান্তি কী এবং এটি যুদ্ধের পোশাক পরে আসে না। এটি আকাশ থেকে পড়ে না। শান্তি কেবল সেখানেই অর্জন করা যেতে পারে, যেখানে স্বাধীনতা রয়েছে। এবং তারা যতবারই আক্রমণ করুক না কেন, ফিলিস্তিন থেকে ইরান পর্যন্ত জনগণ অটুট, অকৃত্রিম এবং সন্ত্রাসের কাছে কখনই নতজানু হবে না। (আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর)
আহমদ ইবসাইস: আইনের ছাত্র এবং প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি আমেরিকান
