Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এ যুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী ইরানি জনগণ

Icon

রামজি বারৌদ

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ যুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী ইরানি জনগণ

গত ২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন। প্রায় দুই সপ্তাহের যুদ্ধের পর এ সিদ্ধান্ত। ইসরাইল যুদ্ধ শুরু করে ১৩ জুন একটি অপ্রত্যাশিত হামলা চালিয়ে, যেখানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কর্মীসহ অসংখ্য বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরাইলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ে, যার ফলে তেল আবিব, হাইফা, বিরসেবা এবং অন্য আরও অনেক জায়গায় বোমার সতর্ক সংকেত বাজে এবং দেশজুড়ে অভূতপূর্ব ধ্বংসসাধন হয়।

যুদ্ধ শুরুতে দুই দেশের মধ্যে থাকলেও তা দ্রুত একটি বড় সংঘর্ষে পরিণত হয়। সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সংঘাত হয়। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থানে-ফোর্ডো, নাতানজ ও ইস্পাহান-পুরাদস্তুর হামলা চালায়, যা ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে পরিচিত। ৫০৯তম বোমারু উইংয়ের সাতটি বি-২ বোমারু উড়োজাহাজ মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ারফোর্স বেস থেকে অবিরাম উড়ে এই হামলা চালায় বলে জানা যায়।

পরদিন ইরান কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায় এবং ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিশোধ নেয়। এটি ছিল এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়।

কৌশলগত পরিণতি

১২ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল তার দুটি লক্ষ্য অর্জন করে। প্রথমত, তেহরানের সঙ্গে সংঘর্ষে সরাসরি ওয়াশিংটনকে টেনে আনা, যা ভবিষ্যতে ইসরাইলের আঞ্চলিক যুদ্ধগুলোতে মার্কিন হস্তক্ষেপের জন্য বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক অর্জন ছিল মার্কিন সামরিক সমর্থনকে ইসরাইলের ‘বিজয়’ হিসাবে উপস্থাপন করা।

তবে এই স্বল্পমেয়াদি লাভের বাইরে ইসরাইলের কৌশলের ফাটল স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। নেতানিয়াহু তেহরানে সরকার পরিবর্তন করতে পারেননি, যা তার বহু বছরের চেষ্টা এবং আসল লক্ষ্য ছিল। বরং তিনি একটি দৃঢ়, ঐক্যবদ্ধ ইরানের মুখোমুখি হন, যারা নিখুঁত ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ইসরাইলকে প্রতিহত করেছে। আরও খারাপ হলো, তিনি হয়তো আঞ্চলিকভাবে এমন এক নতুন সচেতনতা উদ্দীপ্ত করেছেন, যা ইসরাইলের আকাঙ্ক্ষার জন্য আরও বেশি হুমকিস্বরূপ।

অন্যদিকে, ইরান এই সংঘর্ষ থেকে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মার্কিন ও ইসরাইলি চেষ্টার পরও তার পারমাণবিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ন ও কার্যকর রয়েছে। তেহরান একটি শক্তিশালী নতুন প্রতিরোধ সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেছে; প্রমাণ করেছে যে, তারা কেবল ইসরাইলি শহরে নয়, পুরো অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইরান এই যুদ্ধ এককভাবে লড়েছে, হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ বা ইরাকি মিলিশিয়াদের ওপর নির্ভর না করে। এই স্বাধীনতা অনেক পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করেছে এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে।

ইরানীয় ঐক্য

এ যুদ্ধের সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ইরানের অভ্যন্তরীণ জাতীয় ঐক্যের উত্থান এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বের ব্যাপক সমর্থন, যা ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রাণহানির মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। বহু বছর ধরে ইসরাইল ও তার মিত্ররা ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে, এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও দেশটিকে পরিত্যক্ত হিসাবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা এর বিপরীতটিই দেখেছি। বাগদাদ থেকে বৈরুত পর্যন্ত, এমনকি রাজনৈতিকভাবে সতর্ক আম্মান ও কায়রো শহরেও ইরানের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। এই ঐক্য ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

ইরানে যুদ্ধ অন্তত আপাতত সংস্কারপন্থি ও রক্ষণশীলদের গভীর বিভাজন মুছে দিয়েছে। অস্তিত্বগত হুমকির মুখে ইরানের মানুষ একত্রিত হয়েছে, কোনো এক নেতা বা দলের চারপাশে নয়, তাদের মাতৃভূমি রক্ষায়। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার উত্তরসূরিরা এমন মর্যাদা ও গৌরব নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যা কোনো বিদেশি আগ্রাসন নষ্ট করতে পারেনি।

পারমাণবিক প্রশ্ন

যুদ্ধক্ষেত্রের এই উন্নয়নের পরও এ যুদ্ধে আসল ফলাফল নির্ভর করবে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির পরবর্তী পদক্ষেপে কী করে। যদি তেহরান পারমাণবিক বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়, অল্প সময়ের জন্য হলেও এবং তার কর্মসূচি কার্যকর রয়েছে বলে সংকেত দেয়, তাহলে ইসরাইলের তথাকথিত ‘সাফল্য’ অর্থহীন হয়ে যাবে। তবে যদি ইরান এই সামরিক সংঘাতের পর সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নেতানিয়াহু মিথ্যা বা সত্য হোক, দাবি করতে পারবেন যে তিনি ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থামিয়েছেন।

একটি নির্মিত নাটক

কিছু মিডিয়া এখন ট্রাম্পকে এই বলে প্রশংসা করছে যে, তিনি নেতানিয়াহুকে ইরানের বিরুদ্ধে আরও হামলা বন্ধ করার ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন। এই বিবরণ যতটা মিথ্যা, ততটাই অবমাননাকর। আমরা যেটা দেখছি, সেটা একটি সাজানো রাজনৈতিক নাটক-দুই অংশীদারের (ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রর) মধ্যে একটি পরিকল্পিত মনোমালিন্যের খেলা, যেখানে উভয়পক্ষই একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছে। ট্রাম্পের ‘ব্রিং ইয়োর পাইলটস হোম’ পোস্টটি শান্তির আহ্বান ছিল না। এটি ছিল নেতানিয়াহুর যুদ্ধের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের পর বিশ্বস্ততা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি হিসাব-নিকাশপূর্ণ কৌশল। এটি ট্রাম্পকে একজন মধ্যপন্থি নেতা হিসাবে উপস্থাপন করে, যুদ্ধে ইসরাইলের পরাজয়ের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয় এবং মার্কিন প্রশাসন ইসরাইলের আক্রমণ রোধ করছে, এমন মিথ্যা ধারণা তৈরি করে। বস্তুত, এটি সব সময় একটি যৌথ মার্কিন-ইসরাইলি যুদ্ধ ছিল।

জনগণের প্রত্যাবর্তন

সব সামরিক হিসাব-নিকাশ ও ভূরাজনৈতিক নাটকের মাঝে একটি সত্য স্পষ্ট : প্রকৃত বিজয়ী হলো ইরানের মানুষ। যখন সবচেয়ে জরুরি ছিল, তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা বুঝেছিল বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বকে এবং নিজেদের, স্মরণ করিয়ে দিল যে, সংকটের মুহূর্তে মানুষ ইতিহাসের পার্শ্বচরিত্র নয়, তারা তার রচয়িতা।

তেহরানের বার্তা স্পষ্ট : আমরা এখানে আছি। আমরা গর্বিত। এবং আমরা বিচ্ছিন্ন হবো না। এটাই সেই বার্তা, যা ইসরাইল এবং সম্ভবত ওয়াশিংটনও প্রত্যাশা করেনি। এবং এটি সেই বার্তা, যা আগামী বছরগুলোতে এ অঞ্চলের পুনর্গঠন করতে পারে।

অ্যান্টিওয়ার ডটকম থেকে ভাষান্তরিত

ড. রামজি বারৌদ : সাংবাদিক, লেখক এবং দ্য প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম