Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইরানে হামলায় ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি

Icon

ওলামাইড স্যামুয়েল

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানে হামলায় ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি

ছবি: সংগৃহীত

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়ার দাবির পর আরও বলেছিল, বিশ্ব এখন অনেক বেশি নিরাপদ। কিন্তু হামলার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আসলে কতটা পিছিয়ে গেছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি যেমন বলেছেন, কংক্রিটের স্তরের গভীরে কী টিকে আছে, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকার করেছে, কমপক্ষে একটি স্থান বাঙ্কার-বাস্টিং বোমা দিয়ে আঘাত করা যায়নি, কারণ সেটি ভূগর্ভস্থে ছিল। ইরানের সেন্ট্রিফিউজ এবং ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতের অবস্থা তাই অজানাই রয়ে গেছে।

পারমাণবিক বিস্তার রোধ করার পরিবর্তে এ অদূরদর্শী সামরিক পদক্ষেপ পারমাণবিক হুমকিকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে, যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যকেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। এ আক্রমণের আগ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মূলত শান্তিপূর্ণই ছিল। এটি ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ‘অ্যাটমস ফর পিস’-এর সহায়তায় চালু হয়েছিল। কয়েক দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সব দিক IAEA-এর সূক্ষ্ম নজরদারির মধ্যে ছিল। ১৯৬৮ সালে ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) স্বাক্ষরকারী দেশ হয়ে ওঠে; যা আইনগতভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা ত্যাগ করা এবং সব পারমাণবিক উপকরণ IAEA সুরক্ষার অধীনে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইরান ১৯৭৪ সালে একটি ব্যাপক সুরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৮টি পারমাণবিক স্থাপনা ও নয়টি স্থানের বাইরের স্থাপনা (LOF) ঘোষণা করে, যেখানে পারমাণবিক উপকরণ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছিল সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, গবেষণা চুল্লি, রূপান্তর এবং জ্বালানি তৈরির সুবিধা, পরীক্ষাগার ও হাসপাতালে ব্যবহৃত রেডিওআইসোটোপ। মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে ২০০২ সালের আগে গোপন স্থানগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর IAEA আরও হস্তক্ষেপমূলক যাচাইকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং ইরানকে অতিরিক্ত প্রোটোকল বাস্তবায়নের জন্য এবং বর্ধিত পরিদর্শনের জন্য চুক্তি করতে চাপ দেয়। দেশটি ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্বেচ্ছায় তা করেছিল। ২০১৫ সালে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে ব্যাপকভাবে যৌথ কর্মপরিকল্পনা (JCPOA) স্বাক্ষর করে। এটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ওপর কঠোর সীমা মেনে নেয় এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে তার ইউরেনিয়াম মজুত ৯৭ শতাংশ কমাতে সম্মত হয়।

IAEA-কে ইরানের কর্মসূচিতে আগের চেয়েও বেশি অ্যাক্সেস দেওয়া হয়েছিল এবং রিয়েল টাইম পর্যবেক্ষণের অনুমতি হিসাবে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ক্যামেরা ও রিমোট সেন্সর স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ সম্প্রসারিত প্রবেশাধিকার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সব প্রধান স্থানকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে নাতানজ, ফোরডো ও ইসফাহান-যে স্থাপনা তিনটিতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালিয়েছে।

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার প্রথম মেয়াদে JCPOA থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় তিনি দাবি করেন, এর বিধান অনুসারে ইরান ‘খুব কমের বিনিময়ে খুব বেশি’ পেয়েছে। চুক্তিটি সংরক্ষণের জন্য ইউরোপীয় মিত্রদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ইরানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার জন্য ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের প্রচারণা শুরু করে। ট্রাম্পের প্রত্যাহারের ফল দ্রুতই দেখা গিয়েছিল। চুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ইরান যেসব বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিল, ক্রমেই তা হ্রাস করতে শুরু করে। ২০২০ সালে ট্রাম্পের নির্দেশে বিমান হামলায় ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর তেহরান ঘোষণা করে, তারা আর পারমাণবিক চুক্তির কোনো কার্যকর সীমা দ্বারা আবদ্ধ থাকবে না।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, ট্রাম্পের পদক্ষেপ ইরানের সঙ্গে নতুন কোনো আলোচনাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার অধীনে থাকা মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে আলোচনা আবারও শুরু করার চেষ্টাও করেছিলেন। বেশ কয়েক দফা পরোক্ষ আলোচনাও হয়েছিল। সেসময় নতুন কোনো চুক্তি হলে তা আবারও লঙ্ঘন করা হবে না বা একতরফাভাবে আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না, ইরানি নেতারা এ নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। যদিও এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন খুব কমই নমনীয়তা দেখিয়েছে, বরং তাদের পক্ষ থেকে আরও কঠোরতাই দেখা গেছে।

মার্কিন-ইসরাইলি হামলা চলমান আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় আরেক দফা আলোচনা বাতিল করে এবং তার আলোচকদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়। বোমা হামলার পরের দিনগুলোতে ইরানের সংসদ এনপিটি ত্যাগের জন্য আইন প্রণয়ন শুরু করে। ইরান যদি এ চুক্তিতে পৌঁছায়, তাহলে তা বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মূল চুক্তিকেই ভেঙে ফেলতে পারে।

এনপিটির বাইরে ইরান আর কোনো সীমা বা পরিদর্শনের দ্বারা আবদ্ধ থাকবে না, যার ফলে বিশ্ব তার কার্যকলাপ সম্পর্কে অন্ধকারে থাকবে। একটি অস্বচ্ছ ইরানি পারমাণবিক কর্মসূচি সম্ভবত অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে একই কাজ করতে উৎসাহিত করবে। এর ফলে কয়েক দশকের যে সংযম, তা ভেঙে দেবে। যদিও ইরান এখনো ঘোষণা করেনি, তারা NPT ত্যাগ করছে, তার সংসদ IAEA-এর সঙ্গে সব সহযোগিতা বন্ধ করার জন্য আইন পাশ করেছে। এটি একটি স্পষ্ট লক্ষণ, অব্যাহতভাবে ইরানের বহুপাক্ষিক কূটনীতির সম্ভাবনাও ম্লান হয়ে আসছে।

অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য আমেরিকার এখনো সুযোগ আছে। সেটি করতে হলে তাকে কূটনীতিতে দ্বিগুণ জোর দিতে হবে এবং যে গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তার মুখোমুখি হতে হবে। তেহরান তার পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি একটি ন্যায্য চুক্তি প্রস্তাব করা হয়, তবে তারা তাদের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত রপ্তানি করতে এবং আবার সমৃদ্ধির মাত্রা সীমাবদ্ধ করতে ইচ্ছুক। যদিও তারা সম্পূর্ণরূপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অধিকার ত্যাগের বিষয়টি অস্বীকার করে।

এখনো পারমাণবিক বিস্তারের ঝুঁকি মোকাবিলায় কূটনীতি এবং ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম, ঝুঁকিপূর্ণ একতরফা পদক্ষেপ নয়। ইরানে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলাগুলো ছিল গুরুতর কৌশলগত ভুল। এ ক্ষতি পূরণ করতে হলে কূটনীতির কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি অনেক বিষয় পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হবে।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তরিত

ড. ওলামাইড স্যামুয়েল : আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ওপেন নিউক্লিয়ার নেটওয়ার্কের বিশেষজ্ঞ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম