মার্কিন আধিপত্যের দিন কি শেষ
জিনয় জোস পি.
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডোনাল্ড ট্রাম্প/ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কথিত একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে: ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই বিশ্ব চলতে পারে।’ শি, মাও বা কনফুসিয়াসের নামে এ ধরনের অনেক পোস্ট দেখা যায়। এসব পোস্টের মূল উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে তিনি কথাটি বলেছেন কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে, তিনি তা বলে থাকতে পারেন।
ইতিহাসবেত্তা পল কেনেডি ১৯৮৭ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব গ্রেট পাওয়ার্স’-এ ‘সাম্রাজ্যের অত্যাধিক প্রসারিত হওয়ার’ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তার তত্ত্বে বলা হয়েছে, বড় বড় সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন ঘটে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে: অর্থনৈতিক শক্তির কারণে তার সামরিক সম্প্রসারণকে সম্ভব করে তোলে। তবে সামরিক দায়বদ্ধতা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। আর অল্প সময়ের মধ্যেই বহাল থাকতে পারে না।
স্পেন, ব্রিটেন ও রোম নিয়ে কেনেডি যা বলেছেন, তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারেও আরোপ করা যেতে পারে। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে ১৯৪৫ সাল থেকে মার্কিন প্রাধান্য যেসব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলো কাঁপছে, অনেক স্তম্ভে ফাটল স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
আমরা সবাই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মহাশক্তিধরের মতো আত্মপ্রকাশ করেছিল। তারা তখন বিশ্বের শিল্পসামগ্রীর অর্ধেক উৎপাদন করত। মার্শাল প্ল্যান পুনর্গঠন বিশ্ব অর্থনীতিকে মার্কিন মূলধনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিল।
কিন্তু তা ছিল আট দশক আগের ঘটনা। বর্তমানে চীন হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় লেনদেনকারী দেশ। ১৯৪৫ সালে বিশ্বের মোট শিল্প উৎপাদনের মোটামুটি অর্ধেক যেখানে হতো যুক্তরাষ্ট্রে, এখন সেখানে হয় মাত্র প্রায় ১৬ শতাংশ। অবশ্য পেন্টাগন এখনো প্রায় ৭৫০টি বৈদেশিক ঘাঁটি, ১১টি বিমানবাহী রণতরি পরিচালনা করে, বার্ষিক বাজেট প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এতে সাম্প্রতিক সময়ে কী সাফল্য এসেছে?
আফগানিস্তান? ২০ বছরের লড়াইয়ের পর কাবুলে উড়ছে তালেবান পতাকা। ইরাক? ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি ইসলামিক স্টেট এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। লিবিয়া, ইয়েমেন কিন্তু আমেরিকার পথে চলেনি। মার্কিন সামরিক বাহিনী এখনো বিশাল। তবে তার হস্তক্ষেপ এখন আর সম্ভ্রম জাগায় না। বরং সংশয়, বিদ্রুপ, প্রতিবাদ উসকে দেয়।
এমনকি মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বের মূলে যে পরমাণু মনোপলি ছিল, সেটিও এখন আর ট্রাম্পকার্ড নয়। জেন জি এবং জেন আলফাসহ তরুণরা প্রশ্ন করছে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের থাকতে পারলে ইরানের কেন পরমাণু অস্ত্র থাকতে পারবে না?
যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও একসময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক পুঁজিবাদের দুর্গ বলে বিবেচিত হতো, এখন সেগুলোকে ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সামনে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পগুলো সংকুচিত হচ্ছে। ডলার এখনো প্রভাবশালী থাকলেও বি-ডলারিকরণ মূলধারায় জোরদার হচ্ছে।
আমেরিকান সফট পাওয়ারেরও পতন ঘটছে। এমন সময়ও ছিল, যখন নীল জিন্স ছিল বিদ্রোহ, জাজ ছিল বিপ্লব, আমেরিকান মুভি দেখা ছিল স্বাধীনতার টিকিট। এখন? হলিউড ঝিমিয়ে পড়েছে, গতানুগতিকে পরিণত হয়ে পড়েছে। বলিউড, কে-ড্রামা, টার্কিশ সোপ অপেরা, এমনকি চীনা ঐতিহাসিক নাটকগুলো পর্যন্ত ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নেটফ্লিক্সের গ্লোবাল হিটগুলো এখন কেবল লস অ্যাঞ্জেলস থেকে আসছে না, বরং সিউল, মাদ্রিদ ও কোপেনহেগেন থেকেও বের হচ্ছে। আমেরিকার প্রযুক্তি খাত এখন আর অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন অনেক বেশি এআই পেটেন্ট দাখিল করছে।
মার্কিন ডলার এখনো বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা। বৈদেশিক লেনদেনের ৮৮ শতাংশ হয় এ ডলারে। তবে এখানেও ফাটল দৃশ্যমান। সৌদি আরব পর্যন্ত ইউয়ান দিয়ে তেল বিক্রি করছে। রাশিয়া ও চীন নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করছে। একসময় যে অবরোধ ছিল মার্কিন কূটনীতির হাতিয়ার, এখন সেটার কারণে অনেক দেশ ডলারে বিনিময় থেকে বিরত থাকছে।
ন্যাটো ৭৫ বছরে পড়ছে। তবে পরিচিতি সংকটে রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার এ জোট এখন দমবন্ধ অবস্থায় পড়ে গেছে।
এখন কেবল আমেরিকার কথাই শোনা যায় না; বিশ্বের অনেক স্থানে টিকটকই প্রভাব বিস্তারকারী। আর সামাজিক মাধ্যম তো আছেই। সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমস এখনো গুরুত্বপূর্ণ। তারা এখন আর একমাত্র বয়ান তৈরি করতে পারছে না। অনেকেই ভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে।
তবে এসবের অর্থ এই নয় যে, আমরা চীনা শতকে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কারণ ড্রাগনের দেশেও অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তবে এখন যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, পরে কে আসবে তা আর ওয়াশিংটন ডিসি নির্ধারণ করছে না। বহুমেরুর আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে।
আমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘ আমেরিকান শতকে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে এ পরিবর্তন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর তা আমরা পুরোনো সাম্রাজ্য কামনা করি বলে নয়, বরং আমরা অবশেষে অন্যান্য সম্ভাবনার কথা কল্পনা করতে পারছি বলেই। ইতিহাস যদি আমাদের বলে, নেতৃত্ব কখনো চিরস্থায়ী হয় না, তাহলে কারও বিভ্রমে পড়া উচিত হবে না।
ফ্রন্টলাইন থেকে অনূদিত
জিনয় জোস পি. : ডিজিটাল এডিটর, ফ্রন্টলাইন
