Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

‘রেড ফ্ল্যাগ’ দেখানোর সময় এটা নয়

Icon

মোহাম্মদ সফিউল্লাহ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘রেড ফ্ল্যাগ’ দেখানোর সময় এটা নয়

জাতিসংঘের অনুরোধে, কিছু শর্ত সাপেক্ষে, মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে রাখাইনের করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসা এবং ইদানীং বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তানের মধ্যে একটি আঞ্চলিক জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় সংযুক্তি ও পরে অপারগতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়তা (Centrality) খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমারের মানবিক করিডোর প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচণ্ড বাধা-বিপত্তির মুখে একটি ঘোলাটে পরিস্থিতিতে সরকারের পিছুটান দেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় মূল দায়িত্ব কার হাতে ন্যস্ত, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। তদুপরি গৃহযুদ্ধে লিপ্ত বিবদমান অঞ্চলে করিডোর দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত যেখানে, সেখানে অবশেষে জানা গেল, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কোনো অর্থপূর্ণ যোগাযোগ করা ছাড়াই বিদেশি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানো হয়েছে। সর্বোপরি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতার দিকে লক্ষ্য না রেখে একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া কতটুকু সমীচীন ছিল, সেই প্রশ্ন করা যেতে পারে। নীতিগতভাবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত থেকে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে ফিরে আসায় জাতিসংঘ ও অন্য সংস্থার কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার (Credibility) ঘাটতি দেখা দিয়েছে কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে।

সদ্যসমাপ্ত কুংমিং ইনিশিয়েটিভ ত্রিরাষ্ট্রীয় জোট গঠনের প্রয়াস ও প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। যদিও চীনের আগ্রহে এ প্রক্রিয়ার সূচনা, তবে অনেকে মনে করেন, এটা মূলত পাকিস্তানের প্রচেষ্টায় চীনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সংযুক্তির একটি প্রয়াস। বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় তিন দেশের ভিন্ন ভিন্ন বিবৃতি প্রচারের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, এই জোটের আসল উদ্দেশ্য অন্তর্নিহিত রয়েছে। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, পরবর্তীকালে একটি বিবৃতি প্রদান এবং প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সমাপ্তি পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সহযাত্রার কেরাভন থেকে কেটে পড়ে বাংলাদেশে চীনের জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সূচনা করেছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শেখ হাসিনা-পরবর্তী ১০ মাসে কী অবস্থানে আছে, তা নতুন করে ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। তেমনিভাবে পাক-ভারত যুদ্ধের ময়দান থেকে একটি ক্ষণভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি থেকে উঠে আসা ইসলামাবাদের বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান কারও বিরুদ্ধে জোট নয় বর্ণনা করা কোনো মহলের বিশ্বস্তটা পাবে? বাংলাদেশ-চীন-ভারত সম্পর্কের বর্তমান পটভূমিতে এ ধরনের জোট গঠনের এ সময়ে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।

শুধু একটি মিটিংয়ের মাধ্যমে জোট গঠিত হওয়ার নজির নেই। দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ অস্থায়ী ও অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে একটি সুদূরপ্রসারী জোটের প্রস্তাবনা ও অংশগ্রহণে সম্মত হয়? চীনকে প্রথম থেকেই নিবৃত্ত করার যথেষ্ট পজিটিভ উপাদান সরকারের ছিল। তখন চীন বাংলাদেশের অবস্থান মূল্যায়ন করে অংশগ্রহণের জন্য কোনো চাপই সৃষ্টি করত না বলে আমাদের বিশ্বাস। তখন চীন বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা এবং অপারগতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত। যাত্রাপথে পিছুটান দিয়ে চীনের জন্য বাংলাদেশ একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গতিপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। তৃতীয়ত, ভারতের কাছে বাংলাদেশের দুর্বলতা প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ফলে গঙ্গা পানি চুক্তি ভারতের কঠোর শর্তাবলির আওতায় এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চতুর্থত, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অতিমাত্রায় ঘেঁষাঘেঁষির ফলে ট্রাম্প প্রশাসনে বাণিজ্য শুল্ক আলোচনা কতটুকু সুবিধা পাবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকল।

মোট কথা, পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার কেন্দ্রীয়তা হারিয়েছে বলে মনে হয়। পররাষ্ট্রনীতি এখন ভাসমান। নোঙর দিতে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয়তা পুনর্বহাল করার কোনো বিকল্প নেই।

মোহাম্মদ সফিউল্লাহ : সাবেক রাষ্ট্রদূত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম