Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইসলাম ও পাকিস্তান আন্দোলন

Icon

ড. হাসান মাহমুদ

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম ও পাকিস্তান আন্দোলন

ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাস কোনো নীরব, একরৈখিক ঘটনা নয়, বরং একটি বিশ্লেষণীয়-জটিল বয়ান। আজকের পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়া ও রাজনীতি প্রায়ই নির্বাচিত অংশ দিয়ে ইতিহাসকে নতুন সাজিয়ে তোলে, ছেঁটে দেয়, বাছাই করে ‘একটি নির্দিষ্ট বয়ান’ সৃষ্টি করে। এ বয়ান কখনো রাষ্ট্রীয় আদর্শকে উজ্জীবিত করে, কখনো বা রাজনৈতিক চেতনার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে। কিন্তু এ বয়ানের আড়ালে থেকে যায় বহু অনুচ্চারিত, ভুলে যাওয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দেওয়া তথ্য।

বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসচর্চার বাইরে থেকে এলে দৃশ্যমান হয় ‘পাকিস্তান=একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র’, ‘জামায়াত=ধর্মান্ধতা’, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ=ইসলাম ধর্মের পৃষ্ঠপোষক’-এরকম একটি একরৈখিক বক্তব্য, যা ইতিহাসকে স্লোগান আর রাজনৈতিক কুতর্কে পর্যবসিত করেছে।

পাকিস্তান আন্দোলন ধর্মনির্ভর ছিল না, বরং রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষের মুসলমান জনগোষ্ঠীর জাতীয় নিরাপত্তার দাবিতে সিক্ত ছিল, যেই সত্যটা চেতনা-ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস প্রায়ই উপেক্ষিত বা বিকৃত করেছে। এটা প্রমাণ করার জন্য আমাদের প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ।

লাহোর প্রস্তাব ও দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যাখ্যা : রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি

১৯৪০ সালের ২২-২৪ মার্চে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তানের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। কিন্তু এটি ধর্ম নয়, ‘রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা’ সুরক্ষার ভিত্তিতে করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্ব বা ধর্মচিন্তার ভিত্তিতে নয়, বরং মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা ও রাজনৈতিক ভূমিকায় স্বাধীনতার দাবিতে উত্থাপিত হয়েছিল। প্রস্তাবটি পাশের পরই এর বিপরীতে ইসলামি দলগুলোর মত পাওয়া যায়। জামিয়াত উলামায়ে হিন্দ, মজলিসে আহরার, অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস, শিয়া কনফারেন্স, জামিয়াত আহলে হাদিস ইত্যাদি ইসলামপন্থি দল এর বিরোধিতা করে। তারা যুক্তি দেয়, এটি ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে ইসলামি মিশনের জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য দ্বিধা তাদের মনে সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর অভিমতও ১৯৪১-১৯৪৬ পর্যন্ত এ অবস্থায় ছিল।

এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়, পাকিস্তান আন্দোলন ধর্মতান্ত্রিক বা ইসলামি আদর্শে চালিত কোনো আন্দোলন ছিল না। বরং এটি ছিল মুসলিমদের জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার দাবির ভিত্তিতে একটা সেক্যুলার আন্দোলন।

জিন্নাহ : ধর্মনিরপেক্ষ নাকি আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক?

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি স্বাধীন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন-‘আপনি যে কোনো ধর্মের হতে পারেন, যা নিয়ে রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই।’ ১১ আগস্ট ১৯৪৭ ভাষণেও তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় বলেন : ‘পাকিস্তান কখনো ধর্মযাজকের শাসিত ধর্মরাষ্ট্র হবে না।’

তারপর তিনি আবারও পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলো এখন তোমাদেরই; হিন্দু, খ্রিষ্টান, পার্সিদের অধিকার একই থাকবে।’ এ মন্তব্যগুলো প্রমাণ দেয়, তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক, সংবিধানভিত্তিক রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ইসলামকে সমাজ ও বিচারব্যবস্থায় রাখার কথা বললেও তার মধ্যে ধর্মীয় পুরোহিতদের রাজনীতি থেকে আলাদা রাখারও প্রবল ইচ্ছা ছিল।

তার বর্ণাঢ্য জীবন, ব্যারিস্টারি ক্যারিয়ার, এবং নিশ্চিত জীবনযাত্রার কারণে অনেকে তাকে ‘ধর্মচেতনা থেকে বিচ্যুত’ বললেও বাস্তবে তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র, যা ধর্মের প্রাধান্যে নয় বরং সব নাগরিকের সমান অধিকারের ভিত্তিতে চলবে।

অপরপক্ষে, বিভিন্ন ইসলামি দল নির্বাচন ও কাজগুলো জাতীয়তা-ভিত্তিক হওয়ার চেষ্টা করলেও, বাস্তবে তারা রাষ্ট্র-গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর বিরোধিতা করেছিল। সম্প্রসারণকালে এ দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ধাপে ধাপে পরিবর্তন করে, কখনো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশ নেয়, কখনো রাজাকার হয়ে যায়, আবার কখনো মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

চেতনা ইন্ডাস্ট্রি : খণ্ডিত ইতিহাস ও বিপজ্জনক বয়ান

বাংলাদেশের রাষ্ট্র-গঠনের পরে গড়ে ওঠা জাতীয় ইতিহাসচর্চা ‘চেতনা ইন্ডাস্ট্রি’র বয়ানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে

* জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে দেখানো হয়;

* জিন্নাহকে উপস্থাপন করা হয় ইসলাম ধর্মের ত্রাণকর্তা হিসাবে, যদিও তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক ছিলেন;

* পাকিস্তানকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে উপস্থাপন করে।

ইতিহাসচর্চায় প্রয়োজন ‘বহুস্তর বিশ্লেষণ’ ও তথ্যভিত্তিক সংলাপ

বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থ’ভিত্তিক ইতিহাস পড়ার সময় খুব কমই আদর্শগত দ্বৈততার বিশ্লেষণ, সাংবিধানিক ভাষণের বিশ্লেষণ বা প্রশ্ন করার বিষয়গুলো দেখা যায়। স্বাধীনতা, রাষ্ট্র নির্মাণ ও জাতীয়তা নিয়ে আজকের প্রজন্মের প্রশ্ন আছে-‘আমরা কেন এত বিভ্রান্ত?’, ‘আদর্শ ও বাস্তবের সন্ধিক্ষণে আমরা কি হারিয়ে যাই?’

আমরা সম্পূর্ণতা, সব পক্ষের অবস্থান, ভাষ্য ও মতান্তরসহ চাই তথ্যভিত্তিক ইতিহাস-জিন্নাহর বক্তৃতা, পাকিস্তান সংবিধান, জামায়াত ও ইসলামি দলগুলোর সিদ্ধান্ত সবসময় সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা। ভারতবর্ষে লাখ লাখ হিন্দু ও মুসলিম শান্তিপূর্ণ একত্রে বসবাস করলেও পাকিস্তান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কী এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে আসতে হলো? এই প্রশ্নের জবাব জানা দরকার।

রাষ্ট্রকে গণ বা ধর্মভিত্তিক না করে তথ্যভিত্তিক ভাবতে হবে

পাকিস্তান আন্দোলন ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে ছিল না। এটি ছিল ‘মুসলিম জাতীয় নিরাপত্তা ও আত্মপরিচয়’ সুরক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন। ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পরিচিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ছিল, কিন্তু ধর্মানুষ্ঠানিকতা নয়। তারপর জামায়াত ও অন্য ইসলামি সংস্থা আবার একই রাষ্ট্র রক্ষায় অংশ নিয়েছিল, যদিও আদর্শত তারা বিরোধী ছিল। এ দ্বৈত অবস্থার বিশ্লেষণই ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও প্রশ্নাত্মক করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে দরকার সব পক্ষের মতো একটি দ্বৈত সমাজ-রাষ্ট্র সম্বন্ধে মার্জিত আলোচনা। ইতিহাসকে প্রশ্নভিত্তিক, তথ্যভিত্তিক ও বিশ্লেষণাধর্মী করে গড়ে তুলতে শেখা। আমরা যখন তা করতে পারব, তখনই আমরা সচেতন জনগণ হিসাবে, সমাজ হিসাবে এবং জাতি হিসাবে ইতিহাসকে শুধু শিক্ষা নয়, বরং সত্যের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারব।

ড. হাসান মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কাতার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম