Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জুলাই বিপ্লবের স্লোগান : ভাষা ও চেতনার অন্তরবয়ান

Icon

মীর সালমান শামিল

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই বিপ্লবের স্লোগান : ভাষা ও চেতনার অন্তরবয়ান

স্লোগান একটি আন্দোলনের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও শ্রুতিগ্রাহ্য প্রকাশভঙ্গি। এটি শুধু একটি বাক্য নয়; বরং এটি একসঙ্গে ভাষা, আবেগ, চেতনা ও প্রতিরোধের একটি সংগীত। সমাজে যখন অনিয়ম, নিপীড়ন বা শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামে, তখন তারা প্রথমে যা খোঁজে তা হলো একটি ভাষা, যার মাধ্যমে তারা প্রতিবাদ জানাতে পারে। এ ভাষাই স্লোগান।

স্লোাগান তত্ত্ব

স্লোগান আন্দোলনের আত্মা, চেতনা ও বার্তাকে সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালীভাবে প্রকাশ করে। স্লোগান শব্দটির উৎপত্তি স্কটিশ গ্যালিক শব্দ sluagh-ghairm থেকে, যার অর্থ ‘যুদ্ধের চিৎকার’। সমাজবিজ্ঞানে স্লোগানকে দেখা হয় একটি আদর্শ বা চেতনার ঘনীভূত, আবেগনির্ভর, সংক্রামক উচ্চারণ হিসাবে।

স্লোগানের গুরুত্ব নিয়ে ইতিহাসে প্রথম কারা আলোচনা করেছেন, তা নির্দিষ্টভাবে বলা কিছুটা কঠিন। কারণ স্লোগান মূলত রাজনৈতিক, সামরিক এবং ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই জড়িত। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক পলিম্যাথ অ্যারিস্টটল তার ‘Rhetoric’ গ্রন্থে বক্তৃতা, আবেগপ্রবণ ভাষা ও শব্দের প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। তিনি ‘স্লোগান’ শব্দটি ব্যবহার না করলেও জোরালো ভাষার প্রভাব নিয়ে আলাপ করেছিলেন।

ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে একাধিক স্লোগানধর্মী বক্তব্য সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ এটি কেবল তাওহিদের ঘোষণা নয়, বরং ছিল মক্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক চরম চ্যালেঞ্জ। ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনীতি ও যুদ্ধ-সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।

ফরাসি দার্শনিক জ্যাক রুশো ও ম্যাক্সিমিলিয়েন দ্য রোবসপিয়ের স্লোগানকে রাজনৈতিক চেতনা জাগানোর অস্ত্র হিসাবে দেখেছেন। স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ফরাসি বিপ্লবের প্রধান স্লোগান হিসাবে বিবেচিত।

কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস স্লোগানকে শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে চিন্তা করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের (১৮৪৮) ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও’- আধুনিককালের প্রথম বৈশ্বিক স্লোগান।

স্লোগান নিয়ে বিশদ আলাপ করেছেন মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিদা। ফুকো দেখান, সমাজে ‘সত্য’ বা ‘জ্ঞান’ কী হবে, তা নির্ধারিত হয় ক্ষমতার কাঠামোর মাধ্যমে। ফুকো মনে করতেন, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানেই প্রতিরোধের সম্ভাবনা আছে। স্লোগান হলো সেই প্রতিরোধের ভাষাব্যবস্থা, যা বিদ্যমান ডিসকোর্সের বাইরে বিকল্প চিন্তার সম্ভাবনা গড়ে তোলে।

উপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে আলজেরিয়ার তাত্ত্বিক মালিক বেন নাবি মনে করতেন যে স্লোগান হতে হবে চিন্তাসম্পন্ন। তিনি চেয়েছিলেন নিজস্ব চিন্তা ও ভাষাভিত্তিক জাগরণ। আলি শারিয়াতির মতে স্লোগান হলো আত্মশুদ্ধি, প্রতিরোধ ও বিপ্লবের সামগ্রিক প্রকাশ। তিনি বলেছিলেন : ‘প্রতিটি বিপ্লবের প্রয়োজন একজন হোসাইন, এবং প্রতিটি কারবালার দরকার একটি স্লোগান।’ অর্থাৎ, স্লোগান হলো প্রতিরোধ, আত্মত্যাগ ও নৈতিক বিপ্লবের ভাষা।

স্লোগানের কার্যকর দিকগুলো-

১. চেতনা ও আবেগ জাগ্রত করে : স্লোগান মানুষকে আবেগতাড়িত করে, তাদের মনে রক্ত গরম করা বার্তা পৌঁছে দেয়। এটি সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

২. বার্তা সহজভাবে ছড়ায় : স্লোগান সাধারণ ভাষায় আন্দোলনের মূল বক্তব্য বলে। দীর্ঘ বক্তৃতা না শুনেও বোঝা যায়, আন্দোলন কী দাবি করছে।

৩. ঐক্য গড়ে তোলে : একই স্লোগান একসঙ্গে বললে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংহতি সৃষ্টি হয়। স্লোগান তখন ‘আমরা’-র পরিচয় তৈরি করে।

৪. প্রতিরোধের ভাষা হয়ে ওঠে : স্লোগান অনেক সময় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখেও মানুষ স্লোগান দিয়ে দাঁড়াতে সাহস পায়।

৫. শত্রু ও লক্ষ্য চিহ্নিত করে : স্লোগানের মাধ্যমে আন্দোলনের বিরোধীদের চিহ্নিত করা যায়।

জুলাই বিপ্লব ও স্লোগান : বাস্তব প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের সর্বব্যাপী বিস্ফোরণ ছিল জুলাই বিপ্লব। শ্রমজীবী, কৃষক, পোশাকশ্রমিক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ আন্দোলনে অংশ নেয় এবং তাদের আবেগ, বেদনা ও প্রতিরোধের মনোভাব প্রতিফলিত হয় স্লোগানগুলোয়। নিচে কিছু প্রধান শ্রেণি অনুযায়ী শ্রেষ্ঠতম স্লোগান তুলে ধরা হলো-

বার্তা সহজভাবে ছড়িয়ে দেওয়া স্লোগান

‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’; ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে;’ ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই;’

‘এক, দুই, তিন, চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়;’ ‘কলম ছেড়ে লাঠি ধর, স্বৈরাচার বিদায় কর।’

প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভাষার (সহিংসতাবিরোধী প্রত্যুত্তর) স্লোগান

‘পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোট গায়ে পরো;’ ‘বুলেট বোমা টিয়ার গ্যাস, জবাব দেবে বাংলাদেশ।’

জাতীয়তাবাদী ও সার্বভৌমত্ব সচেতনতাবিষয়ক স্লোগান

‘চমশা পরা বুবুজান, নৌকা নিয়ে ভারত যান;’ ‘ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান;’ ‘দিল্লি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা;’ ‘ভারত যাদের মামার বাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি;’ ‘পেতে চাইলে মুক্তি, ছাড় ভারত ভক্তি।’

ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদ ও শহীদ স্মরণভিত্তিক স্লোগান

‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে;’ ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না;’ ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইরে ফিরায়া দে;’ ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে;’ ‘কলম ছেড়ে লাঠি ধর, স্বৈরাচার বিদায় কর।’

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রত্যাখ্যানবিরোধী স্লোগান

‘শেখ হাসিনার গদিতে, আগুন জ্বালাও একসাথে;’ ‘আওয়ামী লীগের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে;’ ‘শেখ হাসিনার সরকার আর নাই দরকার;’ ‘এক দফা এক দাবি শেখ হাসিনা কবে যাবি;’ ‘দফা এক দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ;’ ‘এক, দুই, তিন, চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়;’ ‘ছিঃ ছিঃ হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না;’ ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে।’

আন্দোলনমূলক ও আদর্শভিত্তিক স্লোগান (প্রতিরোধ ও সংগ্রাম)

‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম;’ ‘দালালি না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ;’ ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে;’ ‘তুমি কে আমি কে? বিকল্প বিকল্প;’ ‘হাম লাড়কে লেঙ্গে, আজাদি;’ ‘গোলামি না আজাদি-আজাদি আজাদি;’ ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার রাজাকার;’ ‘লড়াই লড়াই, লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই;’ ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর;’ ‘লাশের হিসাব কে দেবে, কোন কোটায় দাফন হবে।’

বিদ্রূপমূলক স্লোগান

‘পা চাটলে সঙ্গী না, চাটলে জঙ্গি;’ ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, দেশটা কি তোর বাপ দাদার;’ ‘পুলিশ তুমি পোশাক ছাড়ো, মুজিব কোট গায়ে পরো।’

ধর্মীয় বা উম্মাহভিত্তিক চেতনার স্লোগান

‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর;’ ‘সাবিলুনা সাবিলুনা আল জিহাদ আল জিহাদ;’ ‘শেখ মুজিব ঘোড়ার ডিম, জাতির পিতা ইব্রাহিম।’

এই স্লোগানগুলো শুধু সময়ের দলিল নয়, বরং তারা ইতিহাসের ভাষা রচনা করে। এগুলো ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি ভেঙে দিয়ে নতুন বিকল্পের সম্ভাবনা তোলে। জুলাই বিপ্লবের স্লোগানগুলো তাই শুধু বিক্ষোভের নয়, বরং ভাষার, চেতনার এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামের সজীব রূপরেখা।

জুলাই বিপ্লবের স্লোগানগুলো দেখায়, কীভাবে একটি আন্দোলন তার ভাষা নিজেই নির্মাণ করে নেয়, কীভাবে মানুষ রাষ্ট্রীয় বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে। কখনো তারা ধর্মীয় চেতনার আশ্রয় নেয়, কখনো জাতীয়তাবাদের ভাষায় কথা বলে, কখনো বা সরাসরি শাসক ও শত্রুকে আঘাত করে। স্লোগানের শ্রেণিবিন্যাস থেকে বোঝা যায়, জুলাই আন্দোলনের স্লোগানগুলো শুধু ক্ষোভ নয়-এগুলো ছিল রাজনৈতিক চেতনা, আত্মপরিচয়, জাতির ভবিষ্যৎ ও নৈতিক অবস্থানের বহুমাত্রিক ভাষ্য। স্লোগান ছিল এ আন্দোলনের দার্শনিক ও সাংগঠনিক মেরুদণ্ড।

একটি স্লোগান শুধু রাজনৈতিক অভিব্যক্তি নয়, বরং সমাজের অন্তর্লীন চেতনা ও সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। আজকের বাংলাদেশে স্লোগান তাই শুধু বিদ্রোহ নয়-ভবিষ্যতের ভাষাও।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম