কেন কথায় কথায় ভারতের দাদাগিরি
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দীর্ঘদিন ধরে দখল হয়ে থাকা জমি উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ অভিযান চালাতে গিয়ে অবৈধভাবে নির্মিত মসজিদ-মন্দিরসহ বহু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাজধানীর খিলক্ষেতে রেলের এমনই কিছু জমি ছিল। সেখানে থেকে অভিযানের সময় একটি টিনশেডের দুর্গা মন্দির সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটিই এখন গুজবে সৃষ্ট ‘সাম্প্রদায়িক’ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক হলো-এ দেশে এখন কথায় কথায় অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়; বিশেষ করে গত এক বছরে এ প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে-কথায় কথায় ভারতের বিবৃতি। দেশটির অবাঞ্ছিত দাদাগিরিতে আমরা ভীষণভাবে বিরক্ত।
অস্থায়ীভাবে তৈরি করা খিলক্ষেতের মন্দির সরিয়ে নেওয়ার জন্য রেলওয়ে আগেই নোটিশ দিয়েছিল। কিন্তু কিছু মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যম শুরু করেছে পরিকল্পিত অপপ্রচার। বিশেষ করে ভারতের কিছু উগ্রপন্থি অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া ছবি, বিভ্রান্তিকর ভিডিও, যেগুলোতে একে ‘হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের’ গল্প প্রচার করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ গুজব? পতিত আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক আশ্রয় খোঁজে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ভেতরে। ভারতে রয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী একটা গোষ্ঠী। এ গোষ্ঠী এবং তাদের মিডিয়া বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখতে চায়, বিশ্ববাসীকে সেভাবেই দেখাতে চায়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং কিছু আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা উসকে দিতে আগ্রহী। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যাই বলুক না কেন, বাস্তব তথ্য বলছে ভিন্ন কথা : বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে ‘ব্যাপক নির্যাতনের’ কথা বলা হচ্ছে, তা ভুয়া। বিষয়টি বিবিসি ভেরিফজ, ফ্যাক্ট ওয়াচ, ব্র্যান্ডওয়াচ-সবাই নিশ্চিত করেছে।
লিটন দাসের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেটাও ছিল মিথ্যা। সেটা ছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি-রাজনৈতিক টার্গেট ছিল, ধর্মীয় নয়। আগেও দেখা গেছে, ঢাকায় মসজিদ সরানো হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে। কিন্তু তখন তো গর্জে ওঠেনি কেউ! বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে হটলাইন চালু করেছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে রক্ষা করছে উপাসনালয়. ঘরবাড়ি। মসজিদ-মন্দির পাহারা দেওয়ার ঘটনা তারই প্রমাণ।
বিভ্রান্তিকর গুজবের বিরুদ্ধে থাকুন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করতে চায় যারা, তারা চিহ্নিত শত্রু। এ দেশে হিন্দু-মুসলমান, সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে স্বাধীনতা এনেছে, একসঙ্গেই এগিয়ে যাবে-এটাই স্বাভাবিক। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভিন্ন কোনো চক্রান্ত করে এখানে সুবিধা করতে পারবে না।
রেলের জায়গা উদ্ধার প্রসঙ্গে খিলক্ষেত থানার ওসি মো. কামাল হোসেন বলেন, রেলের জায়গাতে মন্দির ছিল। এতদিন টিনের বেড়া ছিল। গত সোমবার ২৩ জুন মন্দির কর্তৃপক্ষ পাকা দেওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করলে স্থানীয়রা বাধা দেয়। এতে উত্তেজনা দেখা দিলে রাত ১০টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
অপসারিত মণ্ডপটি ছিল সম্পূর্ণ অননুমোদিত এবং দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে রেলের জমি দখল করে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। শুক্রবার ২৭ জুন রাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও একথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওই অভিযানে শুরুতে প্রায় ১৫০টি দোকান, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পর অস্থায়ী মন্দিরটি সরানো হয়। মন্দিরে থাকা প্রতিমা যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদার সঙ্গে বালু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পূজার আয়োজকরা গত বছর দুর্গাপূজার সময় রেলের জমিতে অনুমতি ছাড়াই অস্থায়ী পূজামণ্ডপ নির্মাণ করেন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে পূজা শেষে মণ্ডপ সরিয়ে নেওয়ার শর্তে সাময়িকভাবে পূজা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পরও আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মণ্ডপটি সরিয়ে নেননি। বরং সেখানে স্থায়ী মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন। একাধিকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা দখলদারি অব্যাহত রাখে। ফলে জনস্বার্থে এবং সরকারি সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মণ্ডপটি উচ্ছেদ করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা : ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় রেলের জমিতে অস্থায়ী মণ্ডপ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে সরকার। শুক্রবার (২৭ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মণ্ডপটি পূজা শেষে সরানোর শর্তে অনুমতি দেওয়া হলেও আয়োজকরা সরায়নি। বরং সেখানে মহাকালী মূর্তি স্থাপন করে মণ্ডপটি স্থায়ী করার চেষ্টা করা হয়।
রেলওয়ের দাবি, ঢাকা-টঙ্গী রুটে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য রেললাইনের আগের ২০০ ফুট জায়গা খালি করা জরুরি। স্থানীয় দোকান, রাজনৈতিক কার্যালয় এবং অস্থায়ী মণ্ডপসহ সব অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। সবশেষ ২৬ জুন রেলওয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। উচ্ছেদের সময় মণ্ডপের মূর্তি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপস্থিতিতে বালু নদীতে সম্মানের সঙ্গে বিসর্জন দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারি জমি পুনরুদ্ধারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বৈধভাবে নির্মিত উপাসনালয় পূর্ণ সুরক্ষা পায়। কিন্তু সরকারি জমি দখল করে কোনো ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ অনুমোদিত নয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সব সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা ও উপাসনালয় সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষায় কখনো পিছপা হয়নি।
সরকারের এ বক্তব্যকে গ্রহণ না করে শুক্রবার শ্রীশ্রী সার্বজনীন মন্দির ভাঙার অভিযোগে প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে জাতীয় হিন্দু মহাজোট, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণী জোট।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ভারতও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উলটো অবৈধ জমি ব্যবহারের যুক্তিতে ভাঙার অনুমতি দিয়েছে। আমরা অত্যন্ত হতাশ। লক্ষণীয়, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তা সত্য হোক, আর মিথ্যা হোক ভারত বিবৃতি দেবে। এটা অনেকটা নিয়মে পরিণত করেছে দিল্লি। অথচ ভারতে অহরহ সংখ্যালঘুরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। প্রশ্ন হচ্ছে-তাদের ব্যাপারে এতটা উদাসীন কেন বিজেপি সরকার? এখানে কিছু ঘটলে এরা কথায় কথায় বিবৃতি দেয় কেন? ভারতের এ দাদাগিরি বন্ধ হওয়া জরুরি। আমরা এটা দেখতে চাই না, যেমন চাই না কথায় কথায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে।
