নিউইয়র্কের চিঠি
মামদানিকে মেয়র দেখতে চান না যারা
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে এশিয়ান বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানির বিজয়কে হজম করতে পারছেন না আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বেশকিছু হেভিওয়েট ডেমোক্রেট নেতা। তারা জোট বেঁধেছেন আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত মেয়র নির্বাচনে যে কোনো উপায়ে মামদানিকে পরাজিত করতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো খোলামেলাই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিউইয়র্ক সিটিকে পরিচালনা করার জন্য আমরা একজন কমিউনিস্টকে নির্বাচিত হতে দিতে পারি না। তাহলে নিউইয়র্ক সিটি আর আগের অবস্থায় থাকবে না।’ তিনি আরও বলেছেন, জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে প্রয়োজনে তিনি নিউইয়র্ককে ফেডারেল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করার কথা ভাববেন। তার মতে, হোয়াইট হাউজের অসীম ক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্থান পরিচালনার। এ প্রসঙ্গে তিনি ওয়াশিংটন ডিসির অপরাধহার বৃদ্ধির উল্লেখ করে রাজধানী শহরকেও সরাসরি হোয়াইট হাউজের নিয়ন্ত্রণে আনার সম্ভাবনার কথা বলেন। অথচ মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওয়াশিংটন ডিসির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গত বছরের ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ওয়াশিংটনের বর্তমান ডেমোক্রেট মেয়র ম্যুরিয়েল বাউসার একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী, যিনি ২০১৫ সালে প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর টানা তৃতীয়বারের মতো রাজধানী শহরের মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে তার তৃতীয় মেয়াদ শেষ হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বারবার নির্বাচিত জনপ্রিয় মেয়রও ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ‘উত্তম ব্যক্তি’ নন।
তার দৃষ্টিতে তিনি বা তারাই ‘উত্তম ব্যক্তি’, যারা হোয়াইট হাউজের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বা আনুগত্যের সম্পর্ক বজায় রাখবে। নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান ডেমোক্রেটিক মেয়র এরিক অ্যাডামসও একজন আফ্রিকান-আমেরিকান, যিনি সিটির চারশ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে নির্বাচনি তহবিলে নিউইয়র্কে ঠিকাদারি কাজে নিয়োজিত ধনবান বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ চাঁদা নিয়ে এফবিআই’র তদন্তের মুখে পড়েন। তদন্তে অভিযোগের পক্ষে দলিলপত্র আটক করা হয়। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে, পদত্যাগ করা ছাড়া তার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। তাকে যে কোনো সময় গ্রেফতার করা হতে পারে, এমন পরিবেশও সৃষ্টি হয়। তিনি তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টির আস্থা হারান। ইতোমধ্যে ২০২৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এবং গত জানুয়ারিতে তার শপথ গ্রহণের আগে মেয়র অ্যাডামস ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গ্রেফতার এড়ান এবং তার পদ রক্ষা করেন। সোজা কথায় বলা যায়, মেয়র এরিক অ্যাডামস এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আশীর্বাদের ছায়াতলে আছেন। যদিও তিনি অ্যাডামসের সঙ্গে তার সম্পর্ককে একটি ‘পরীক্ষা’ বলে বর্ণনা করেছেন। নিউইয়র্কের মেয়র হিসাবে অ্যাডামস যেহেতু ডেমোক্রেটিক পার্টির আস্থা হারিয়েছেন, অতএব মেয়র পদে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার আশার চেয়ে নিজের মুখ রক্ষার জন্য তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রিয়তাও যে রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে, নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্তকরণে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে জোহরান মামদানির বিপুল বিজয় তার প্রমাণ। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোকে ১ লাখ ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য অ্যান্ড্রু ক্যুমো তিন দফা নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে তার বিরুদ্ধে কয়েকজন নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনার পর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পিতা মারিয়ো ক্যুমোও তিন মেয়াদে নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে স্বল্প পরিচিত তরুণ অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানির কাছে পরাজয় স্বীকার করার অন্তর্জ্বালা তার মধ্যে বিদ্যমান। তিনি তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে বেপরোয়া হয়ে মাঠে নামবেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
অতএব অ্যান্ড্রু ক্যুমো তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টির আরও কিছুসংখ্যক হেভিওয়েট নেতার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। গত সপ্তাহে তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, আর মাত্র ক’মাস পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে মেয়র পদে জোহরান মামদানিকে পরাজিত করতে সম্ভাব্য সব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। তাদের মধ্যে এখন আর দলীয় শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধ কাজ করছে না। একটাই লক্ষ্য তাদের-মামদানির চূড়ান্ত বিজয়কে অসম্ভব করে তোলা। সন্দেহ নেই, হেভিওয়েট ডেমোক্রেটদের নতুন এই উদ্যোগে মামদানি ও তার সমর্থকরা তাদের ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দেওয়ার মতো হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু করার কিছু নেই, অবাধ স্বাধীনতার দেশ আমেরিকায় আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে কেউ কিছু করলে তাকে বাধা দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
গত মাসে অনুষ্ঠিত প্রাইমারিতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রাজনীতিতে উচ্চাভিলাষী জোহরান মামদানি ডেমোক্রেটিক পার্টিতে উদীয়মান এক রাজনৈতিক প্রতিভা। তিনি ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে তিন মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন। সিটি মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে তার অসামান্য বিজয় তাকে তার দলেরই বেশকিছু নেতার চক্ষুশূলে পরিণত করেছে। কারণ, মামদানি জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় পোড় খাওয়া ডেমোক্রেটদের ছাড়িয়ে গেছেন। অতএব নভেম্বরের চূড়ান্ত নির্বাচনে কীভাবে তাকে পরাজিত করে তার অগ্রযাত্রার লাগাম টেনে ধরা যায়, তারা এখন সেই কৌশল উদ্ভাবনে ব্যস্ত। প্রাইমারিতে তাকে ঠেকাতে অ্যান্ড্রু ক্যুমো সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সিটির বিত্তবানরা তার নির্বাচনি তহবিলে অঢেল অর্থ চাঁদা দিয়ে প্রাইমারিতে তাকে জয়ী করতে কম চেষ্টা করেনি। তার তহবিলে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছিল। কিন্তু সবকিছুর ওপর গভর্নর থাকাকালে তার বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকানদের একটি অংশ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহবহির্ভূত নয় এমন যৌনাচার মেনে নিলেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনো ধরনের যৌন আচরণ সাধারণভাবে সহ্য করে না। ক্যুমোর পক্ষে তার কলঙ্কমুক্ত স্বচ্ছ রাজনৈতিক ইমেজ ফিরিয়ে আনা কষ্টকর ছিল।
অন্যদিকে জোহরান মামদানির শক্তি ছিল নিউইয়র্ক সিটির তরুণ সমাজ এবং দরিদ্র, স্বল্প ও মাঝারি আয়ের লোকজন। তিনি সিটি ও সিটিবাসীর উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কর্মসূচি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন, মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি সেই কর্মসূচিগুলোর সিকিভাগও বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাতে তার জনপ্রিয়তা দিনে দিনে আরও বৃদ্ধি পাবে। এটাই সিটির গুরুত্বপূর্ণ ডেমোক্রেট নেতাদের আশঙ্কার কারণ। মামদানি যাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মাঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন, সে জন্য তারা নিশ্চেষ্ট বসে নেই। তারা নভেম্বরে মামদানিকে পরাজিত করার কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করার পর ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, প্রাইমারিতে বিজয়ী হওয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে যেহেতু মামদানি ছাড়া অন্য কাউকে মেয়র প্রার্থী করার সুযোগ নেই, অতএব তার বিজয় ঠেকাতে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট ডেমোক্রেট স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তারা হচ্ছেন, প্রাইমারিতে মামদানির কাছে পরাজিত অ্যান্ড্রু ক্যুমো, বর্তমান সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস। এছাড়া তৃতীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে যাচ্ছেন সাবেক ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদ জিম ওয়াল্ডেন।
নভেম্বরের নির্বাচনের আগেই মামদানি ও তার সমর্থকদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার কৌশল হিসাবে গত সপ্তাহে জিম ওয়াল্ডেন প্রস্তাব দিয়েছেন, মামদানিসহ মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী চারজন ডেমোক্রেটের মধ্যে আসন্ন বসন্ত মৌসুমে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়া উচিত ‘ফ্রি-মার্কেট প্রার্থী’ হিসাবে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বোঝা যাবে কারা মামদানিকে তার সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদকে সমর্থন করেন। তিনি মনে করেন, এ ধরনের একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে মামদানিকে পরাজিত করার মোক্ষম উপায়। এ জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করার পরামর্শ দেন জিম। মামদানি নিজেকে ‘ডেমোক্রেট সোশ্যালিস্ট’ হিসাবে ঘোষণা করার ফলে সমাজতন্ত্রবিরোধী ডেমোক্রেটরা ইতোমধ্যে তাদের আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তাদের বিশ্বাস, মামদানি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিম বলেন, এ জরিপে যারা জয়ী হবেন না, তারা বিজয়ীকে নভেম্বরের নির্বাচনে সমর্থন করবেন।
জিম ওয়াল্ডেনের প্রস্তাবকে গত সোমবার সমর্থন করেছেন অ্যান্ড্রু ক্যুমো, নিউইয়র্ক স্টেটের আরেক সাবেক ডেমোক্রেট গভর্নর ডেভিড এ প্যাটারসন। শুধু তাই নয়, জিম তার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেখানে উপস্থিত থেকে তার প্রস্তাব সমর্থন করেছেন রিপাবলিকান বিলিয়নিয়ার জন ক্যাটসিম্যাটিডিস এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক, রেডিও হোস্ট সিড রোজেনবার্গ। নিউইয়র্ক সিটির রেজিস্টার্ড ডেমোক্রেট ও রেজিস্টার্ড রিপাবলিকান ভোটার সংখ্যার অনুপাত যথাক্রমে ৬:১। এ পরিস্থিতিতে মামদানিকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় তিন ডেমোক্রেট স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু ক্যুমো, এরিক অ্যাডামস ও জিম ওয়াল্ডেন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস সিলওয়ার মধ্যে ভোট বিভাজিত হয়ে যাওয়া। কিন্তু তারা তা হতে দেবেন না। ভোট ভাগ হওয়া প্রতিরোধ করার জন্যও তারা কৌশল এঁটেছেন। তারা তাদের সমর্থন স্থির ও সংহত করার জন্য কেবল একজন প্রার্থীকে সমর্থন করে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে ভোট বিভক্ত করা ঠেকাবেন। অতএব এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আগামী ৪ নভেম্বর নিউইয়র্ক সিটির ১১৩তম মেয়র নির্বাচনে মেয়র পদে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করা জোহরান মামদানির জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক
