Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভিয়েতনাম পারল, আমরা কেন পারলাম না

Icon

ড. মোস্তফা কে মুজেরী

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভিয়েতনাম পারল, আমরা কেন পারলাম না

ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করেছে। এ ইস্যুটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি সংকোচনের লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নিয়েছে। আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করা হলে স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ব্যয় কমে যাবে। আজ থেকে তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র বর্ধিত শুল্কারোপ সংক্রান্ত খসড়া তালিকা ঘোষণা করেছিল। বিভিন্ন দেশের আপত্তির মুখে বর্ধিত শুল্কারোপের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল।

এ তিন মাস সময়ের মধ্যে কোনো কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর ধার্যকৃত শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্কারোপের কথা জানানো হয়েছিল। ভিয়েতনাম সরকার যুক্তরাষ্ট্রের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাচনার মাধ্যমে তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহার ৪৬ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছিল। সেখান থেকে ২ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ১ আগস্ট থেকে এ বর্ধিত শুল্কহার প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক প্রদান করে থাকে। বর্ধিত নতুন শুল্ক হার বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ (৩৫+১৫=৫০) শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার। বিশেষ একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বৃহৎ গন্তব্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসামগ্রীর একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৪৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। যে সামান্য কয়টি উন্নত দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে সবার শীর্ষে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ মোট ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। একই সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অনুকূলে উদ্বৃত্ত রয়েছে ৬২৬ কোটি ডলার। বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক, ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন সবার শীর্ষে ছিল। দেশটি মোট ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের হিস্যা হচ্ছে ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ মোট ৩৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক সামগ্রীর বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের হিস্যা হচ্ছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর তৃতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনাম একই বছর মোট ৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তাদের বাজার হিস্যা হচ্ছে ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয় ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার মূল্যের।

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উচ্চহারে বাড়তি শুল্কারোপের ফলে দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও নিকটতম প্রতিযোগী হচ্ছে ভিয়েতনাম। তাদের ওপর প্রাথমিকভাবে ৪৬ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সে অবস্থা থাকলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে থাকতে পারত। কিন্তু ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত বর্ধিত শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আগামীতে ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ (২০+১৫=৩৫) শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের মূল্য ভিয়েতনামের সমজাতীয় পণ্যের মূল্যের চেয়ে বেশি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশি পণ্যের পরিবর্তে ভিয়েতনামের পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। মার্কিন আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে বেশি শুল্ক দিয়ে পণ্য আমদানির পরিবর্তে ভিয়েতনাম থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য আমদানির চেষ্টা করবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। সেই সুযোগে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখলের চেষ্টা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের দৃষ্টি তখন ভিয়েতনাম বা অন্য দেশের প্রতি নিবদ্ধ হবে। মার্কিন ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের তুলনায় অন্তত ১৫ শতাংশ কম মূল্যে ভিয়েতনাম থেকে একই ধরনের পণ্য আমদানি করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকসামগ্রী নিয়ে সবচেয়ে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে ভিয়েতনামের সঙ্গে। প্রাথমিকভাবে যখন যুক্তরাষ্ট্র বর্ধিত শুল্কারোপের ঘোষণা দেয়, তখন ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ হারে বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্ধিত শুল্কহার নির্ধারণ করা হয় ৩৭ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সফল আলোচনা মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত বর্ধিত শুল্কহার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্ধিত শুল্কহার কমানো হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। আগে বর্ধিত শুল্কহার ছিল ৩৭ শতাংশ। এখন তা ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্য তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা পাবে। অন্য দেশের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক কমানো হলেও তেমন কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু ভিয়েতনাম অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী। তাই ভিয়েতনাম যদি কোনো ধরনের শুল্ক সুবিধা পায়, তা বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কোনো ধরনের আবেগ দিয়ে চলে না। ভোক্তারা যেখানে তুলনামূলক কম মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য পাবে, সেখান থেকেই পণ্য ক্রয় করবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনাম বাংলাদেশি তৈরি পোশাকসামগ্রীর যতটা ঘনিষ্ঠ প্রতিযোগী, ভারত ততটা নয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে মোট ৩৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা হচ্ছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর ভারত একই বছর ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ভারতের বাজার হিস্যা হচ্ছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের জন্য যতটা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারবে, ভারত তা পারবে না। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের পার্থক্য এখানেই যে, আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য কার্যত তৈরি পোশাকনির্ভর। আর ভারত তাদের রপ্তানি পণ্য তালিকাকে বহুমুখীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসামগ্রী মোট পণ্য রপ্তানির ৮৪ শতাংশের মতো। আর এ শিল্প খাতটি আমদানিকৃত কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজনির্ভর বলে জাতীয় অর্থনীতিতে তৈরি পোশাকশিল্পের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। ভারত এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের রপ্তানি পণ্য তালিকার একটি বড় অংশজুড়ে আছে স্থানীয় কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজনির্ভর পণ্য। ফলে তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রপ্তানি পণ্যের মূল্য সংযোজন তুলনামূলকভাবে বেশি।

ভিয়েতনামের মতো যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ধার্যকৃত বাড়তি শুল্ক আলোচনার মাধ্যমে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, আগামীতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিন মাস সময় দিয়েছিল সমঝোতার জন্য। ভিয়েতনাম এ সুবিধা পুরো মাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সেই আলোচনার সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি।

যুক্তরাষ্ট্র ৯ জুলাই পর্যন্ত আলোচনার সময় দিয়েছিল। আর বাংলাদেশ সত্যিকার আলোচনা শুরু করে ৯ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো, এই তিন মাস আমরা কী করেছি? ভিয়েতনাম তো অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। তারা বিভিন্নভাবে লবিং করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা প্রস্তাবিত বাড়তি শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমরা সঠিক সময়ে সঠিক টিম দ্বারা নেগোসিয়েট করিনি। তাই আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। তবে এখনো সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাড়তি শুল্কহার কমানো যতটা সহজ ছিল, এখন হয়তো ততটা সহজ হবে না।

তবে আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহার একটা যৌক্তিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হতে পারে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে লবিস্ট নিয়োগ করে শুল্কহার কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। (অনুলিখন : এম এ খালেক)

ড. মোস্তফা কে মুজেরী

অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম