দেশের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন তিনি
ড. মোস্তফা কে মুজেরী
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নুরুল ইসলাম। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা নুরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২০ সালের এই দিনে (১৩ জুলাই) তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন সৃজনশীল শিল্পোদ্যোক্তাকে হারিয়েছে। শিল্পায়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়াত নুরুল ইসলামের অবদান জাতি দীর্ঘদিন স্মরণ রাখবে। মানুষ তার কাজের মাধ্যমেই মহত্ত্ব লাভ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নুরুল ইসলাম সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসে যে সামান্যসংখ্যক তরুণ চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, নুরুল ইসলাম তাদের অন্যতম। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলা এবং তরুণ সমাজের জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে আমাদের এ অঞ্চলে যে সামান্যসংখ্যক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল, সেসবের মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। সে অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত উত্তরণের জন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প ছিল না। সামান্য কিছুসংখ্যক তরুণ দেশে নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে নুরুল ইসলামের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
যুদ্ধফেরত নুরুল ইসলাম যদি চাকরির সন্ধান করতেন, তাহলে হয়তো একটি ভালো চাকরি গ্রহণ করে সচ্ছলতার সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্যরকম একজন মানুষ। তিনি ঝুঁকি নিতে জানতেন। উল্লেখ্য, যে কোনো উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে ঝুঁকি গ্রহণের সক্ষমতা এবং সাহস। ঝুঁকি গ্রহণ করতে না পারলে কারও পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয় না। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে অন্যরা যখন একটি ভালো চাকরির চেষ্টা করছিলেন, তখন নুরুল ইসলাম চাকরির খোঁজ না করে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যমুনা শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নুরুল ইসলাম উদ্যোক্তা হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে তাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়।
ব্যক্তি নুরুল ইসলাম ছিলেন দূরদর্শী এবং সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীন দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, নুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর আওতাধীন প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ৪০। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশে যে ক’জন উদ্যোক্তা বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনে সহায়তা করেছেন, নুরুল ইসলাম নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের অর্থনীতিকে মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তাদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
নুরুল ইসলাম একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উদ্যোক্তা হিসাবে তার দৃশ্যমান কোনো ব্যর্থতা ছিল না। তিনি যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। যমুনা শিল্পগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের পণ্য বাজারে নিয়ে এসেছে। তিনি কোনো একটি নির্দিষ্ট খাতে সীমাবদ্ধ থাকেননি। নুরুল ইসলাম শিল্পের যে সেক্টরে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতা পেয়েছেন। এমনকি তিনি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সাফল্য পেয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক যুগান্তর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় পত্রিকা হিসাবে পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত যমুনা টেলিভিশন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে ইতোমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জাতির বিভিন্ন সংকটকালে যমুনা টেলিভিশন অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করে প্রশংসা অর্জন করেছে। শোনা যায়, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতেন না, চাপ দিতেন না। দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনে যারা সাংবাদিকতা করেছেন এবং এখনো করছেন, তারা স্বাধীনভাবেই দায়িত্ব পালন করতে পারছেন।
নুরুল ইসলাম অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ কর্মপাগল একজন মানুষ। নুরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী একজন শিল্পোদ্যোক্তা। ভবিষ্যতে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করে আমাদের দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে, তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। সেই মোতাবেক উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি সফল হয়েছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত যমুনা ফিউচার পার্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য শপিংমল। একজন ভালো উদ্যোক্তার প্রধান গুণ হচ্ছে ঝুঁকি গ্রহণ করার সামর্থ্য থাকা। নুরুল ইসলাম যে কোনো কাজে ঝুঁকি নিতে পারতেন বলেই এত বড় শিল্পগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। এ শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি।
নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। তাই তিনি দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। দেশের প্রতি তার কমিটমেন্ট ছিল লক্ষ্য করার মতো। তিনি জানতেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে স্বাধীনতার সুফল সবার ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তার প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যার্জনে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই। নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কখনোই অর্থ পাচারের কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন। দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। দেশের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ তিনি করেছেন বলে শোনা যায় না।
নুরুল ইসলাম দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, তা পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে। তারাও এ ধারা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছি। আমি নুরুল ইসলামের বিদেহী আত্মার পারলৌকিক শান্তি কামনা করছি।
ড. মোস্তফা কে মুজেরী : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস)
