Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

উদীয়মান উদ্যোক্তাদের প্রেরণা

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উদীয়মান উদ্যোক্তাদের প্রেরণা

নুরুল ইসলাম। ফাইল ছবি

মানুষ চিরঞ্জীব নয়। একদিন না একদিন তাকে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করতে হবেই। এটাই বাস্তবতা। তবে মানুষের এই স্বল্প পরিসরের জীবনে তার কর্ম ও সৃষ্টিশীলতা তাকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখে মনুষ্য হৃদয়ে। নুরুল ইসলাম তেমনই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি একাধারে একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, অপরদিকে একজন সফল গুণী শিল্পোদ্যোক্তাও। সমাজ জীবনে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতিতে অনন্য এক অবদান রেখে গেছেন। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে তিনি রাষ্ট্রকে আরও অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। উদীয়মান শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ। নুরুল ইসলামকে একজন সফল স্বদেশি শিল্পোদ্যোক্তা বলা যায়। কারণ তিনি যা কিছু গড়েছেন, নিজ দেশেই গড়েছেন। দেশের টাকা দেশেই সদ্ব্যবহার করেছেন, যেটা এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এক টাকাও ঋণখেলাপি ছিলেন না। এটা ব্যবসায়ী মহলে বিরল।

২০২০ সালের এই দিনে এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম কর্ণধার নুরুল ইসলাম ভয়াল করোনার ছোবলে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক স্বপ্নচারী উদ্যোক্তাকে। মৃত্যুর সময় তার বয়স যে অনেক হয়েছিল, এমনটি বলা যাবে না। তিনি ছিলেন একজন সুঠামদেহী সুপুরুষ। মৃত্যুর কাছে এত সহজে হার মানবেন, তা কখনো মনে হয়নি। করোনার সঙ্গে প্রায় এক মাস লড়াই করার পর তাকে পরাজিত হতে হয়। তিনি আপনজন, শুভানুধ্যায়ী ও দেশবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি যদি আর ১০টি বছর সময় পেতেন, তাহলে তিনি তার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়ে যেতে পারতেন। এখনো তার হাতে গড়া অর্ধসমাপ্ত পাঁচতারা হোটেলটির ইট-সিমেন্টের কাঠামো আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। নুরুল ইসলামের প্রয়াণের পর এ বিশাল সৌধ কাঠামোতে এক তিল সিমেন্ট-বালুর আস্তর পড়েনি। তারপরও তিনি যতসব অমর কীর্তি রেখে গেছেন, এক জীবনে কোনো মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস হয় না। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/তাই তব জীবনের রথ, পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে।’

নুরুল ইসলাম একজন ধনাঢ্য পুরুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনবোধে এক বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আমরা দেখতে পাই, এ দেশের বেশির ভাগ তরুণ আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে আগ্রহী। এরা দরিদ্র থাকতে চায় না। এরা হতে চায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। দরিদ্র জীবনের গ্লানি এরা একেবারেই পছন্দ করে না। এর পাশাপাশি এখনো একটি বিপরীতমুখী মনোভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে। কেউ অর্থবিত্তের মালিক হলে তাকে দেখে অন্যদের চোখ টাটায়। এটাই হলো আমাদের জীবনের কন্ট্রাডিকশন। তবে এ কথা সত্য, সমাজের সবাই যদি পরস্পরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাচুর্যের জীবনে উন্নীত হতে পারে, তাহলে তার মতো ভালো কিছু হতে পারে না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পুঁজিবাদী সমালোচকরা বলত, সমাজতন্ত্র হলো দারিদ্র্যের বণ্টন। সমাজতান্ত্রিক দেশে সমতা এলেও মানুষের জীবনযাত্রা দারিদ্র‌্যাবস্থায় থেকে যায়। কিছু কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতা অনেকটাই এমন ছিল। ধনীদের জীবন লাগামছাড়া ভোগ-বিলাসের ফলে উচ্ছন্নে যেতে বাধ্য, এমন ধারণা আমাদের সমাজে এখনো বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’য় তার ধনাঢ্য এক চরিত্রের অধস্তন তিন পুরুষের অধঃপাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে চিন্তায় ধনবান হওয়ার ব্যাপারে বহুকাল ধরেই নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করছে।

চীনের নেতা দেং শিয়াও পিং-এর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘ধনী হওয়া খারাপ নয়’-এ উক্তিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। তবে এ ধনী হওয়াকে তিনি সবাই মিলে ধনী হওয়াই বুঝিয়েছেন। তাই চীনের বর্তমান জাতীয় লক্ষ্য হলো ২০৫০ সালের মধ্যে একটি মডারেটলি প্রস্পারাস নেশনে পরিণত হওয়া। পুঁজিবাদী সমাজে জাত পুঁজিপতিরা একটি ডায়নামিজম নিয়ে আসেন। এ গতি বা চলার শক্তি সমাজ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। মরহুম নুরুল ইসলাম তার প্রাথমিক পুঁজি কীভাবে সংগ্রহ করেছিলেন, তা আমার জানা নেই। যেভাবেই তার পুঁজি সংগৃহীত হয়ে থাক না কেন, তাকে তিনি চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। গড়ে তুলেছেন নানারকম শিল্প। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে বাংলাদেশ ছিল শিল্পে অত্যন্ত অনগ্রসর একটি দেশ। টাকা-পয়সা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহার করা যায়, টাকা-পয়সাওয়ালারা অনেকেই ভাবতেও পারতেন না টাকা-পয়সা ব্যবসা-বাণিজ্যে ও শিল্পকারখানা গড়ার জন্য ব্যয় করা যায়। অর্থাৎ তারা টাকা দিয়ে টাকা করতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকা দিয়ে পণ্য তৈরির ঝুঁকি তারা নিতে চাননি। এ অনগ্রসর মনমানসিকতার জগতে নুরুল ইসলাম রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেন নানারকমের শিল্পকারখানা গড়ে তুলে। অর্থাৎ তিনি কাগজের মুদ্রার রূপান্তর ঘটিয়ে বস্তুগত পণ্য তৈরি করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ফ্র্যাংক নাইটের একটি বিখ্যাত গ্রন্থের শিরোনাম হলো ‘রিস্ক আনসার্টেইনটি অ্যান্ড প্রফিট’। এ গ্রন্থে ফ্র্যাংক নাইট দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিশ্চয়তার মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য ঝুঁকি নিতে পারলে মুনাফা আহরণ করা যায়। এ মুনাফা উত্তরোত্তর বিনিয়োগ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়। এটাকেই কাল মার্কস্ বলেছেন, বর্ধিত পুনরুৎপাদন। বর্ধিত পুনরুৎপাদন না থাকলে পুঁজিবাদ হয়ে পড়ত বদ্ধজলাশয়ের মতো স্থবির ও উৎপাদন বৃদ্ধিহীন। মরহুম নুরুল ইসলাম একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের মতো দেশেও বর্ধিত পুনরুৎপাদন সম্ভব। তিনি একের পর এক নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়েছেন। যেমন যমুনা ফ্যান, অ্যারোমেটিক সাবান, পেগাসাস কেড্স, পেগাসাস মোটরসাইকেলের মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। শুধু গার্মেন্টস বা ডেনিম নয়, উৎপাদনের নানা বৈচিত্র্য এনেছেন স্বপ্নবান এ মানুষটি। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ফ্রিজের মতো নানা প্রয়োজনীয় পণ্য। পণ্যের মানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি সবসময় ভাবতেন, পণ্যের গুণগত মানের কারণে যে পণ্য মানুষ একবার কিনবে, প্রয়োজনে সে আবারও সেই পণ্য কিনতে দ্বিধা করবে না।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জোসেফ এ শুম্পিটার বলেছেন, উদ্যোক্তাদের ড্রাইভ, ইনিশিয়েটিভ ও ঝুঁকি গ্রহণের চরিত্র না থাকলে তারা প্রকৃত অর্থে উদ্যোক্তা হতে পারেন না। মরহুম নুরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ঝুঁকি গ্রহণ করতে শিখেছিলেন। শিখেছিলেন ড্রাইভ ও ইনিশিয়েটিভের মতো গুণাবলির চর্চা। যুদ্ধের ময়দানে যেসব চারিত্রিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন তিনি করেছিলেন, সেগুলো অব্যাহত রাখেন শিল্পোদ্যোক্তা হিসাবে জীবনযুদ্ধে। তিনি কখনো ঋণখেলাপি হননি। যে দেশে ঋণখেলাপি হওয়াই বেশিরভাগ তথাকথিত শিল্পপতিদের অভ্যাস, সেখানে বিরল ব্যতিক্রম হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নুরুল ইসলাম। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক সংবাদপত্র যুগান্তর ঋণখেলাপ, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তার নিজের জীবনে এসব পাপাচারের কোনো ঠাঁই ছিল না। তাই নিজের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন এমন এক সমাজসচেতনতা, যা এসব পাপাচারকে ঘৃণা করে। তিনি যমুনা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাকে বিরাট বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর্থিক ক্ষতিও কম হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হয়েছেন প্রথম শ্রেণির স্যাটেলাইট টেলিভিশনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়।

এক নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কারা এ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে-সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। আমার দৃষ্টিতে মনে হয়, তিনটি শ্রেণি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার বর্ম হিসাবে কাজ করে। এ শ্রেণি তিনটি হলো-জাতীয় শিল্পোদ্যোক্তা, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি। জাতীয় শিল্পোদ্যোক্তা স্বাধীনতা রক্ষায় দাঁড়াতে চাইবে তার বাজার রক্ষার জন্য। কৃষক স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে তার জমি ও ফসল রক্ষার জন্য। শ্রমিক শ্রেণি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে তার শ্রমের বাজার অটুট রাখার জন্য। মরহুম নুরুল ইসলামের জন্ম ও জীবন ধন্য হয়েছে দেশপ্রেমিক শ্রেণির কাতারভুক্ত হওয়ার ফলে। নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, পুঁজির সদ্ব্যবহার করার মানুষ। এমনই একজন শিল্প গড়ার কারিগরের বড় প্রয়োজন ছিল এ দেশের। এত অল্প সময়ে তার এ চলে যাওয়াকে কেউই মেনে নিতে পারেনি। তিনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো আরও অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত এ দেশে। দেশের হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হতো। এ দেশে এমন মানুষের জন্ম যেন বারবার হয়, এমন প্রত্যাশাই করি সৃষ্টিকর্তার কাছে। আজ তিনি নেই, তার সৃষ্টি রয়ে গেছে। তিনি সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে, কর্ম নৈপুণ্যে। ওপারে ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন তিনি-সৃষ্টিকর্তার কাছে এ প্রার্থনাই করি।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

ঘটনাপ্রবাহ: নুরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম