শিক্ষা সমাজ দেশ
অভ্যুত্থানের বছরপূর্তির প্রাক্কালে
ড. হাসনান আহমেদ
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বছর পেরিয়ে ৫ আগস্ট আবার ফিরে আসতে চলেছে। সবই সচেতনমহলের নখদর্পণে। আবারও প্রমাণিত হতে চলেছে, এদেশের সব অব্যবস্থা, অধঃপতন ও অনুন্নতির মূলে এদেশের নীতি-আদর্শহারা, দলবাজ রাজনীতিবিদরা ও তাদের অনৈক্য। নইলে দেশ গড়ার এমন সুযোগ আমরা আত্মকলহে ও আত্ম-অহংকারে হাতছাড়া করতে চলেছি কেন? অন্তর্বর্তী সরকারের এখনো পর্যন্ত যে অর্জন, মূল্যবান হলেও সেগুলো স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি অর্জন এখনো হাতে এসে পৌঁছেনি। অনেকগুলোই প্রক্রিয়াধীন। যে ব্যক্তি যত বুদ্ধিমান, সে তত দূরদর্শী। অন্তর্বর্তী সরকার দূরদর্শী হবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলগুলোর যে মনমানসিকতা এতদিনে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে প্রক্রিয়াধীন কর্মকাণ্ডে বেশি আশান্বিত না হওয়াই ভালো।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সার্থকতা নিয়ে বলতে গেলে আবার সেই লালনের গানকে স্মরণ করতে হচ্ছে : ‘আশা পূর্ণ হলো না, মনের বাসনা’। এ কারণেই ২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে ‘আধাখেচড়া’ বিপ্লব নাম দিয়ে আসছি। একমাত্র দেশখেকো বিপ্লব-বিরোধীরাই এতে লাভবান ও পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আশান্বিত হচ্ছে। বিপ্লব সফল ও সমাপ্ত হতে আরও সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। এ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় বিপ্লব শেষ হতে দেওয়া যেতে পারে না।
সংক্ষেপে, বিপ্লবের মূল লক্ষ্যটাই ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত ও সুসংহত করা; আধিপত্যবাদী আগ্রাসন ও শোষণ, আশ্রিত রাজ্যের অবস্থান ও দুঃশাসনের নিগড় থেকে দেশকে বের করে আনা। এদেশের লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ‘পার্শ্ববর্তী দেশের দান’ অবস্থার দাবি থেকে পুনরুদ্ধার করা; অন্য দেশের দাস বা গোলামি করা গাদ্দারদের মুখোশ উন্মোচিত করে দেশ মুক্ত করা; জাতির অস্তিত্ব মূলছিন্ন-পরগাছা-অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে নিজস্ব মূলভিত্তির ওপর দাঁড় করানো; প্রভুর সহযোগে দাস কর্তৃক সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট, অরাজকতা, বিচারহীনতা, এদেশের নিরপরাধ ভূমিপুত্র-মানুষকে প্রতিহিংসার কারণে নির্বিচার গুম-হত্যা থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি। বিপ্লব অনেকটা সার্থক হয়েছে, মানতেই হবে। দেশপ্রেমী মানুষের আশা, বাকিটাও অর্জিত হতে হবে। মনে হচ্ছে, সময় লাগবে, তবে সম্ভব। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা বড় দায়িত্ব পালন আমরা আশা করেছিলাম, কিন্তু ক্ষমতাপ্রেমী ও অনেক ব্যবসায়িক রাজনীতিক অতীতের বিপন্নপ্রায় অবস্থা ও দুর্দশা ভুলে যেতে চলেছে। নির্বাচনকেই দেশ রক্ষার একমাত্র নিয়ামক বলে ভাবছে। আমাদের আশা, আপদমস্তক দুর্নীতির রাহুগ্রস্ত, অসৎ মানসিকতাসম্পন্ন, দুরারোগ্য ব্যামোক্লিষ্ট রাজনীতির কবর দিয়ে রাজনীতির নতুন সুস্থ ধারা চালু হোক।
ব্যামোগ্রস্ত রোগী অপারেশন, কাটা-ছেঁড়া মেনে নিতে চায় না, অনেক সময় অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে জোর-জবরদস্তি, কখনো রোগীর পূর্ণ অ্যানেসথেশিয়া করে কাজ করতে হয়। বর্তমানে রাজনৈতিক দল-নামীয় রোগীর দেহ-মন মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত। আমরা নিজের অনিমিখ-অনিরুদ্ধ চোখ দিয়েও তা-ই বাস্তবে দেখি; হতাশ হই। রোগীর সব কথা ও প্রলাপ শুনতে গেলে তারই জীবন বিপন্ন হয়। রোগীই একমাত্র বোঝে-কথাটা ঠিক নয়। ডাক্তার ও রোগীর হিতাকাঙ্ক্ষীরাও অনেক ভালো বোঝে, এটা মানতেই হবে।
অপারেশনের কাজগুলো ঠিকঠাকমতো হচ্ছে না। রোগী-তোয়াজের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দেশ-বিক্রেতা, লুটেরা ও গণহত্যাকারীদের বিচার যথাযথ হতে হবে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সংস্কার ও রোগগ্রস্ত রাজনীতির সংস্কার দেশোপযোগী ও সময়োপযোগী হতে হবে-এটা এদেশের সাধারণ নাগরিকদের চাওয়া। রাজনীতির সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সংস্কারে সব রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করবে-এটা দুরাশা মাত্র। এখানে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও উপরিল্লিখিত সমস্যাগুলো ও অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আজকের লেখায় সংক্ষেপে দুটো প্রস্তাব দেওয়া যায়।
১. এক্ষেত্রে স্বাধীনতা-অব্যবহিত পরের একটা বাস্তবতা উদাহরণ হিসাবে দিতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমরা একটা নির্দিষ্ট মূলধনের অধিক মূলধনবিশিষ্ট কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করে তার হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসানের জের দীর্ঘ বছর ধরে টেনেছি, এখনো অনেক টানছি। নিুমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথাকে বিবেচনায় এনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা মিল-কলকারখানা জাতীয়করণ করেছিলাম। জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে সিস্টেমকে মেলাতে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলাম। আমি বাম-ঘরানার কমরেডদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, এর ফলে টার্গেট শ্রেণি কোনোভাবেই এ পর্যন্ত উপকৃত হয়নি। উপকৃত হয়েছে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা, ‘বুর্জোয়া সরকারি কর্মকর্তারা’ ও সমসাময়িক ‘রাজনৈতিক বুর্জোয়া নেতারা’। তার বড় ধরনেরর প্রভাব এ পর্যন্ত পড়ে এসেছে আমাদের অর্থনীতিতে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক দল ও নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের আমূল সংস্কার আশু প্রয়োজন। চলতি রাজনৈতিক সংস্কারে দেশবাসী সন্তুষ্ট না। এদেশের রাজনৈতিক সততা, দেশের উন্নয়ন ও দেশসেবার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া অগণিত অসুস্থ দল ও প্রত্যেক দলের নীতিহারা অসংখ্য অঙ্গ-সংগঠনের সদস্যরা। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ-সংগঠন হয়েছে ঠিক মিল-কলকারখানা জাতীয়করণের পরিণামের মতো। অধিকাংশ রাজনীতিক নেতা-কর্মী রাজনীতিকে একটা লাভজনক ব্যবসা হিসাবে নিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ধারাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে গেলে অঙ্গ-সংগঠন আগে বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিকরা নিয়ম মোতাবেক দেশ চালাতে থাকবেন। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে মূল ধারায় এসে রাজনীতি করবে। দেশবাসীর বিশ্বাস, পোকাধরা রাজনীতির বিস্তার যত সংকীর্ণ হবে, দেশ তত ভালো চলবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার এথিক্স ও কোড অব কন্ডাক্ট থাকবে। দেশে আইনের নিরপেক্ষ শাসন থাকবে। আইন অমান্যকারীরা নিরপেক্ষ বিচারের সম্মুখীন হবে। শুধু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও কাঠামোগত সংস্কার ফলপ্রসূ হবে না।
স্মর্তব্য যে, এদেশে রাজনীতি এখন আর কোনো দেশগড়া ও জনসেবার মঞ্চ নয়, রাজনীতি একটা ঝুঁকিবিহীন মুখসর্বস্ব লাভজনক ব্যবসা, মেধাবী-সুশিক্ষিতদের সংখ্যা অনেক কম; এটা বাস্তবতা- দুচোখ মেলে দেখুন। এজন্য রাজনীতিতে এত ভিড়, গরুর হাটের দরদাম, মিথ্যাচার, আদর্শচ্যুতি। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে করা ঠিক নয়। এতে অসংখ্য সংস্কারের অভিনবত্ব বাড়াবে; নতুন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হবে, ভাবার বিষয়। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে আবার রাজনৈতিক দলের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা সুচিন্তার পরিচায়ক হবে না। রাজনীতির প্রকৃতিকে অবশ্যই বদলাতে হবে।
২. রাজনীতির নামে দেশ-শোষণ ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামো রিস্ট্রাকচারিং করা প্রয়োজন। সংস্কারে জটিলতা বাদ দিয়ে সহজ সমীকরণে যাওয়া ভালো। সংস্কারটা এমন হবে যে, রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ববোধের ব্যতয় ঘটলে, প্রত্যাশিত জনসেবা না দিতে পারলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেই বহন করতে হবে। দেশ নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা করতে অঢেল সুয়োগ-সুবিধা বা মুক্ততা দেওয়া কোনোমতেই উচিত নয়। যে কোনো মূল্যে দেশ ও দেশের মানুষকে রাজনৈতিক দলের অসুস্থ জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের উপযুক্ত ভারসাম্য আনতে হবে। রাজনীতিকদের হাতে সরকার চালনার কর্মভার থাকবে। তারা দেশ ও জনগণের সেবা করবেন। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং সরকারের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে দেখভালের দায়িত্ব থাকা প্রয়োজন রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্রে একাকী কেউ এ দায়িত্ব পালন করবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় ১৫ থেকে ২১ সদস্যের একটা ন্যাশনাল কাউন্সিল বা সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। কাউন্সিলের প্রধান হবেন প্রেসিডেন্ট। কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। তারা হবেন দেশের অরাজনৈতিক সুশিক্ষিত পেশাজীবী ও নাগরিক-সমাজের পুরোধা। তারা সম্মিলিতভাবে হবেন জনগণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জিম্মাদার। সেজন্য দেশ পরিচালনায় রাজনীতিকদের সঙ্গে অরাজনৈতিক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের সংমিশ্রণ করতে হবে। এদেশের যত মেধাবী, সুশিক্ষিত, উচ্চ-শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত, দেশ পরিচালনায় অবদান রাখার জন্য আমরা তাদের মূল্যবান ও দক্ষ সহযোগিতা নিতে পারি। এখানেও গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে। কাউন্সিল একটা নির্দিষ্ট-সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক বিধিবদ্ধ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। নির্বাচকমণ্ডলী হতে পারে পুরো দেশব্যাপী দুই লাখ। নির্বাচকমণ্ডলী দেশের অরাজনৈতিক পেশাজীবী ও সুশিক্ষিত নাগরিক-সমাজের মধ্য থেকে গঠিত হতে হবে। রাজনীতির ঘুণে-খাওয়া স্থানীয় সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট কাউকে ন্যাশনাল কাউন্সিলের নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলী করা ঠিক হবে না।
এভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভারসাম্য তৈরি করা যায়। এতে দেশপ্রেমী রাজনীতিবিদরা টিকে থাকার স্বার্থে জনসেবা করতে বাধ্য হবেন, বেপরোয়া-নীতিবিগর্হিত কাজ থেকে বিরত হবেন। দুর্বৃত্ত-দুরাচার পুষলে দেশ-চালনার কাজ থেকে বহিষ্কৃত হবেন। দেশ ও জাতি রাজনীতিবিদদের সুস্থ সেবা পেয়ে ধন্য হোক, এটা সবারই কামনা। কোনো রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে জনস্বার্থবিবোধী বা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে, ‘দলবাজি’ করলে, নেতা-কর্মীরা দুর্নীতি করলে কাউন্সিল তার বিহিত করতে পারবে। ন্যাশনাল কাউন্সিল নির্বাহী বিভাগ, বিচারবিভাগ ও আইনবিভাগের কিছু উচ্চ-স্তরের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে; বিভিন্ন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর বা যখন প্রয়োজন, নির্বাচিত ন্যাশনাল কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে দেশের যে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারবে। সেক্ষেত্রে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ কাজও ওই একই কাউন্সিল করতে পারে। এভাবেই রাজনৈতিক দলের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা ও জবাবহীনতার অবসান হবে। নতুন ধারায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
ড. হাসনান আহমেদ : সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।
