বোর্ড পরীক্ষা : শুধু ফলাফলই কি মানদণ্ড
আজিজুল রমিজ
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সংকট। এ বছর যেমন পাশের হার কমেছে, তেমনি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। কেউ বলছেন, এবার ‘বাস্তব চিত্র’ ধরা পড়েছে, আবার কারও মতে, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এক মানসিক ধাক্কা। এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়া দেখায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত কতটা দুর্বল, যেখানে শেখার প্রক্রিয়া নয়, ফলাফলই হয়ে উঠেছে একমাত্র মানদণ্ড।
যখন পাশের হার বেশি হয়, বলা হয় মান কমেছে। আবার হার কমে গেলে শোনা যায়, শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না। এই বিপরীত প্রতিক্রিয়াগুলো প্রমাণ করে, আমরা এখনো শিক্ষাকে পরিসংখ্যানের মধ্যে আটকে রাখছি। প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে শিক্ষার কোন লক্ষ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি?
ইংরেজি ও গণিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবারও সবচেয়ে বেশি। এই চিত্র নতুন নয়। বহু স্কুলে এখনো গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, অনেক সময় অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করানো হয়। আইসিটি পড়ান এমন শিক্ষকের অনেকেই মাত্র তিন বা ছয় মাসের কোর্স করে এসেছেন, বাস্তব দক্ষতা নেই বললেই চলে। অথচ অন্যান্য বিষয়ের জন্য যেখানে উচ্চতর ডিগ্রি আবশ্যিক, সেখানে এই ব্যত্যয় একধরনের কাঠামোগত বৈষম্য।
শুধু শিক্ষক সংকট নয়, শেখানোর পদ্ধতিতেও সংকট প্রকট। এখনো মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতিই প্রধান। প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল তোলাই যেন প্রধান উদ্দেশ্য। বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা কিংবা বাস্তবজ্ঞান যাচাইয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। ক্লাসরুম হয়ে উঠছে ক্লান্তিকর এক অনুশাসনের যন্ত্র, যেখানে শিক্ষার আনন্দ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার সুযোগ-সুবিধায় শহর ও গ্রামের ব্যবধানও স্পষ্ট। BANBEIS-এর ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রামে অবস্থিত। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত বিজ্ঞানাগার, ডিজিটাল সরঞ্জাম বা পাঠাগার। এমনকি শহরের তুলনায় গ্রামীণ শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণও অনেক কম। মাঠ, কমনরুম, বাগান-এমন মৌলিক জিনিসের অভাবও শিক্ষার পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
অন্যদিকে, শিক্ষক সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চললেও কার্যকর সমাধান হয়নি। অনেক শিক্ষক নিয়োগ পান সুপারিশ বা রাজনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোতে। নিয়োগের আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা যাচাই করা হয় না। ক্লাসে শিক্ষক থাকলেও অনেক সময় থাকে না উৎসাহ, পেশাগত দায়বদ্ধতা কিংবা স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা।
পরীক্ষার আগে প্রয়োজন ক্লাস মনিটরিং, অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন, পাঠদানের মান যাচাই, যা বহু প্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ছে, কিন্তু সেই বিনিয়োগের কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়নি। ফলাফল নির্ভরতার চাপে পড়ে শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার জন্য পড়ে, জীবনের জন্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বিশ্বাস কর, জ্ঞান এক জায়গায় গিয়েই শেষ নয়; সে চলেছে সবখানে, সে রয়েছে সর্বত্র-মানুষের জীবনে, প্রকৃতির বুকে, সমাজের ব্যবস্থায়।’ কিন্তু আমাদের পাঠ্যক্রম এখনো চার দেওয়ালে বন্দি। নদীর গতি শেখানো হয়, কিন্তু নদী দেখা হয় না। অর্থনীতির সংজ্ঞা মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু বাস্তব আয়-ব্যয়ের ধারণা দেওয়া হয় না। এই বিচ্ছিন্নতা শিক্ষার মর্মবোধ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
শিক্ষা মানে কেবল পাশ বা ফেল নয়, কেবল সার্টিফিকেটও নয়। শিক্ষা মানে জীবনকে বুঝে নেওয়া, মানুষ হয়ে ওঠা। ফলাফল সেই যাত্রার একটি দিক মাত্র। কিন্তু যখন সেটাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র মানদণ্ড, তখন তার গভীরতা হারিয়ে যায়। পাশের হার কমে গেলে শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে পড়ে, আবার এ-প্লাসের বন্যায় প্রকৃত মেধা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
এ দুই বিপরীত চাপে একটি প্রজন্ম হারিয়ে ফেলছে আত্মবিশ্বাস ও সম্ভাবনার দিগন্ত।
তাই প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দূরদর্শী ও ন্যায়ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে শিক্ষার গুণগত মান, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব এবং আনন্দময়তা থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে। শিক্ষা হয়ে উঠবে জাতিগত উত্তরণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।
আজিজুল রমিজ : শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
azizulramiz@gmail.com
