মানবিক অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে
সাঈদ খান
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আজ এমন এক জটিল সংকটে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেখানে নৈতিকতা ও মানুষের জন্য রাজনীতির জায়গা ক্রমশ সংকীর্ণ হচ্ছে। খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর দুর্নীতিবাজরা শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও ধ্বংস করছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, খুন, গুম, চাঁদাবাজি এবং নিরীহ মানুষের ওপর সন্ত্রাস-এসব শুধু বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এগুলো আমাদের সমাজ কাঠামোকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে।
একটি সভ্য, মানবিক ও নিরাপদ সমাজ নির্মাণে এসব অপরাধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়া নয়, বরং আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সচেতনতাই হতে পারে টেকসই সমাধান। যে সমাজে দুর্বলরা নিরাপদ নয়, সেই সমাজ টিকে থাকতে পারে না। কাজেই, আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব-খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের রুখে দাঁড়ানো এবং কোনো অবস্থাতেই গণপিটুনির মতো বর্বরতা না ঘটানো নিশ্চিত করা। অপরাধী যে-ই হোক, তার বিচার হোক প্রমাণের ভিত্তিতে, আদালতের কাঠগড়ায়।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেতরে শুদ্ধি, জবাবদিহিতা ও নৈতিক নেতৃত্ব তৈরির প্রয়োজনীয়তা অবহেলা করলে, এ দেশের রাজনীতি আরও নষ্ট হবে। ধর্ষক বা সন্ত্রাসীর রাজনৈতিক পরিচয় নেই-তারা অপরাধী, তাদের বিচার অবশ্যই আইনের আওতায় হতে হবে।
আমরা অনেক সময় দেখি, অপরাধীদের ‘আমাদের’ বা ‘আপনাদের’ বলে ভাগ করে নেওয়া হয়। এতে নিরীহ মানুষ বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধীরা পায় প্রশ্রয়। রাজনীতি কখনো পক্ষপাতের জায়গা হতে পারে না। আইন ও ন্যায়বিচার হওয়া উচিত অপরাধীর জন্য একমাত্র বিচারক। অপরাধীদের রাজনৈতিক রঙে রাঙিয়ে তাদের রক্ষা করা মানে সমাজকে বিভক্ত করা, মানুষের নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদা নষ্ট করা।
অপরাধ ও অপরাধীকে দল-মতের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে বিচার করতে না পারলে, আমরা একটি বিভাজিত সমাজের দিকে ধেয়ে যাই, যেখানে ‘আমার খুনি’ আর ‘আপনার খুনি’ থাকে, কিন্তু ন্যায় থাকে না। এ বিভাজনের ফলে দেশের রাজনীতি হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংঘর্ষময় মঞ্চ। এটি বন্ধ করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের দল থেকে চিরতরে বহিষ্কারে ব্যর্থ হয়, তবে তারা জনগণের আস্থা হারাবে। দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, কালোবাজারি আর মুনাফালোভীদের সঙ্গে রেখে রাজনীতির দূষণ রোধ করা যাবে না। দলগুলো যদি নিজেদের ভেতর থেকে শুদ্ধ না হয়, তাহলে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না-অর্থাৎ গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হবে।
যারা মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করে না-তারা রাজনীতির নামে শুধু ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের ব্যবসা করে। রাজনীতি কোনো অপরাধীর আশ্রয়কেন্দ্র নয়; বরং তা হওয়া উচিত মানুষের অধিকার ও মর্যাদার লড়াইয়ের একটি মহান প্রতিষ্ঠান। এরা সমাজের শত্রু, আর তাদের রাজনীতিতে স্থান দেওয়া মানে গণতন্ত্রের শত্রুতায় অবদান রাখা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো আচরণ করলে বিএনপিরও একই পরিণতি হবে।’ এটা কেবল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়; এটি নিজের দলের প্রতি কঠোর আত্মসমালোচনা এবং নৈতিক শুদ্ধির আহ্বান। আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতার যে দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ আর অরাজকতা তৈরির ইতিহাস বিএনপি দেখেছে, সেটি পুনরাবৃত্তি হলে ফলাফল হবে একই-জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন এবং রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হওয়া।
এ সতর্কতা অপরিহার্য, কারণ রাজনৈতিক শুদ্ধি ছাড়া একটি দল টিকে থাকতে পারে না। জনগণ আজ আর শুধু বক্তৃতা ও প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট নয়; তারা চান সত্যিকার পরিবর্তন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস বা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রশ্রয় দেয়, তারা শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই, বিএনপিকে নিজের ইতিহাস ও অর্জনের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করতে হবে।
রাজনীতিতে ভুল করেননি-এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে, যার ভুলের পরিমাণ যত কম, তিনি তত বেশি সফল। তাকে জনগণ তত বেশি ভালোবেসে মনে রেখেছে। আবার যে নেতা যত বেশি ভুল করেছে, সে তত বেশি নিন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি নিন্দিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত।
তারেক রহমান পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘এখন কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে, আমাদের ওপরে অর্থাৎ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ওপরে। মানুষ অর্থাৎ, দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ এদেশের ভোটার, তারা বিএনপির ওপরে আস্থা রাখতে চাইছে। এ আস্থা যদি নষ্ট করার জন্য কেউ কোনো কাজ করে, তাহলে ভাই, তাকে তো আমার পক্ষে টানা সম্ভব না। তাকে আমি টানব না। তাকে আশ্রয় দেব না। এখানে দলকে ‘স্বার্থপর’ হতেই হবে।
কোনো ব্যক্তির কারণে, নেতার কারণে, কর্মীর কারণে যদি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়, তাকে আমরা ওউন করতে পারব না। কারণ আমরা বহু বহু অত্যাচার-নির্যাতন ও ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতর দিয়ে আজ এখানে এসেছি। কাজেই আমাদের পক্ষে আর সম্ভব না-যে কেউ নিজের বিষয়, নিজের স্বার্থ নিয়ে এমন কিছু করবে, যেটা দলের স্বার্থকে আঘাত করবে, ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তাকে আমাদের পক্ষে টানা সম্ভব না।’
বিএনপির অর্জন ও অবদান ধুলায় মেশানোর অধিকার কারও নেই-এ কথা স্পষ্ট। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, অর্থনৈতিক সংস্কারে, নারীর ক্ষমতায়নে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়, গ্রামীণ উন্নয়নে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। এ ইতিহাসকে ভুলে গেলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভিত্তি দুর্বল হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে শুদ্ধি ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্র্রতিষ্ঠিত হয়।
ধর্ষক, খুনি, দুর্নীতিবাজ, মাদক কারবারি-এরা সমাজের বাইরের কেউ নয়। বৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বিচারহীনতা ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ফাঁকেই এদের জন্ম হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য মনুষ্যত্বকে গরিব করে তোলে। ক্ষুধার্ত মানুষ অস্ত্র ধরে, আদর্শ বেচে দেয়, আর অপরাধ তখন ব্যক্তিগত পাপ নয়, হয়ে ওঠে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। রাজনীতি যখন দুর্নীতির কারখানা হয়, প্রশাসন যখন দলীয় লাঠিয়ালে পরিণত হয়, তখন অপরাধীরা বিচার নয়, পরিচয় দিয়ে বাঁচে। বিচারহীনতার কোলে জন্ম নেয় গণপিটুনি, যেখানে জনগণই আইন হাতে তোলে। তখন খুনি ও বিচারকের মাঝে আর কোনো পার্থক্য থাকে না।
শিক্ষাব্যবস্থা যখন হয় মূল্যবোধহীন, সংস্কৃতি যখন হয় ভোগবাদী আর সমাজ যখন হয় লোভের পূজারি, তখন অপরাধীরা শুধু অপরাধ করে না-নিয়ন্ত্রকও হয়ে ওঠে। তারা হয়ে ওঠে নেতা, ঠিকাদার, মালিক, আর সাধারণ গরিব মানুষ-নির্যাতিত ও বঞ্চিত। বর্তমানে বাংলাদেশে অপরাধ বেড়েই চলেছে: ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং, সিন্ডিকেট, মাদক-সবই চলে রাষ্ট্রের ছায়ায়। সরকার নীরব, বিচার ঘুমন্ত, জনগণ আতঙ্কে। এসব সংকটের প্রতিকার শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সম্ভব নয়; প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর গভীর সংস্কার।
সমাধান একটাই-অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানো, সবার জন্য শিক্ষা, কাজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হলো মূল চাবিকাঠি। রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি আনতে হবে, যাতে মানবিকতা, নারীর মর্যাদা ও যুবসমাজের নৈতিকতা গড়ে ওঠে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো দেখিয়েছে-সুশাসন থাকলে অপরাধ থাকে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই প্রযোজ্য। তবে এর জন্য সবার আগে দরকার একটি নির্বাচিত সরকার।
বাংলাদেশে এক সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা হলো, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভেতর থেকে শুদ্ধ হবে, অপরাধীদের নির্মূল করবে এবং দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব গড়ে তুলবে। অন্যথায়, ইতিহাস তাদের কঠোর বিচার করবে।
রাজনীতি মানুষের জন্য-মানবিকতা, ন্যায়বিচার, সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। তাই এখন সময় এসেছে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করার-রাজনীতিতে অমানুষের কোনো স্থান নেই। এ রাজনীতিকে প্রতিরোধ করেই ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
