Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এরা বাঙালি, না বিজেপি

Icon

অনিকেত চ্যাটার্জি

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এরা বাঙালি, না বিজেপি

ফাইল ছবি

চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে দিল্লির বসন্ত কুঞ্জের জয় হিন্দ কলোনিতে বাঙালি বাসিন্দাদের পানির লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে, উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে। করল কারা? দিল্লি পুলিশ আর আরএএফ। এ জুলাই মাসেই ওড়িশা, পারাদ্বীপ এবং উপকূলীয় জেলাগুলোতে বাংলাভাষী ৪৪৪ শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করা হয়। করল কারা? ওড়িশা পুলিশ। জুনেই মহারাষ্ট্র, মুম্বাই ও থানে থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সাতজন শ্রমিককে ধরে নিয়ে গিয়ে বিএসএফ বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে তারা ঘরে ফেরে। করল কারা? মহারাষ্ট্র পুলিশ ও বিএসএফ। একই বছরের মে মাসে উত্তরপ্রদেশ, কুশিনগর ও মথুরায় বাঙালি মুসলিম ফেরিওয়ালাদের ওপর হামলা ও গ্রেফতার। করল কারা? হিন্দুত্ববাদী কিছু গোষ্ঠী ও পুলিশ। এই মে মাসেই রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারের ১৩ শ্রমিককে বাঙালি হওয়ার কারণে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে ৯ দিন আটক রাখা হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে মুক্তি মেলে। করল কারা? রাজস্থান পুলিশ। কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের পুলিশ হেনস্তা করল। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান রাজ্যগুলোতে আক্রমণের ধরন আরও হিংস্র। উত্তরপ্রদেশের কুশিনগর, মথুরা, দেউরিয়ার মতো জায়গায় বাঙালি মুসলিম ফেরিওয়ালাদের ওপর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো হামলা চালাচ্ছে রেগুলার এবং পুলিশ তাদের আটক করছে। তাদের বাংলাদেশি বলে গালিগালাজ করা হচ্ছে। জিনিসপত্র তছনছ করা হচ্ছে। গুজরাটে ১ হাজার ২৪ জন, রাজস্থানে প্রায় ১ হাজার জনকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছে।

পুশব্যাকের কথা ধরা যাক। বিনা বিচারে বাংলাদেশের নির্বাসন, হেনস্তা এবং আটকের থেকে ভয়ংকর পর্যায় হলো পুশব্যাক বা জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া। ২০২৫ সালের মে মাস থেকে অপারেশন সিঁদুরের সমান্তরাল ওই একই সময়ে দেশব্যাপী এ অভিযান শুরু হয়, যেখানে ২ হাজারের বেশি মানুষকে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গুজরাট, দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য থেকে সন্দেহভাজনদের ধরা হচ্ছে। তারপর তাদের ত্রিপুরা বা আসামের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তাদের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হাতে তুলে দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এ পুরো প্রক্রিয়ার কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা আইনি সহায়তার সুযোগই থাকছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে মর্মান্তিক সব কাহিনি।

এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, অনুপ্রবেশকারী ধরার নামে ভারতীয় নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে। এ পুশব্যাক নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ আক্রমণের শিকার কারা? হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই। সাধারণভাবে মনে করা হয়, এ আক্রমণ শুধু মুসলিমদের লক্ষ্য করে করা হচ্ছে, তা নয়। তথ্যপ্রমাণ যা বলছে, ধারণাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। আক্রমণের মূল ভিত্তি ধর্ম নয়, বরং ভাষা এবং জাতিগত পরিচয়। অর্থাৎ বাঙালি হওয়াটাই যেন অপরাধ। বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী শব্দটা প্রায় মুসলমানদের দিকে আঙুল তোলে আর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ব্যবহারও করা হয়; কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ আরও ব্যাপক। ঘৃণা এবং সন্দেহের জাল এতটাই ছড়ানো, যে কোনো বাংলাদেশি মানুষ তিনি হিন্দু হোন বা মুসলমান হোন, তার শিকার হতে পারেন।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী, অসমিয়া জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমবিদ্বেষকে হাতিয়ার করে আগামী নির্বাচনের মাঠ সাজাচ্ছেন। তিনি সাফ জানিয়েছেন, যদি কেউ নিজেদের সরকারি নথিতে মাতৃভাষা হিসাবে বাংলা লেখে কিংবা ফরম ফিলাপ বা স্কুলে বাংলা ভাষায় তার নাম লেখায়, তাহলে তা তাদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করার ভিত্তি হবে। এসব বলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সবাই জানে। সবাই বোঝে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য এই জঘন্য পরিকল্পনা বাংলা আর বাঙালির বিরুদ্ধে করছেন। আমাদের এ বাংলায় তার প্রতিবাদ হচ্ছে। তৃণমূল নেত্রী রুখে দাঁড়িয়েছেন, বিভিন্ন বামদল থেকে এর বিরোধিতা করা হচ্ছে; কিন্তু এ রাজ্যের বিজেপি, নতুন ইন্টেলেকচুয়াল রাজ্য সভাপতি, যিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা মুখস্থ বলেন, তিনি কী বলছেন? বিরোধী দলনেতা থেকে আপাতত বিদ্রোহী দিলু ঘোষ, তিনি কী বলছেন? কিছুই বলেননি। শুভেন্দু অধিকারী কি বলছেন এগুলো অন্যায় হচ্ছে? না, বলছেন না।

কাজেই প্রশ্ন তো উঠছেই, তুমি বাঙালি না বিজেপি? তারা সম্ভবত কোনোদিন আন্দামানের সেলুলার জেলে যাননি। ওখানে গেলে দেখতে পেতেন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এ বাংলাতে কথা বলা মানুষগুলোর অবদান কী। ইতিহাস পড়েননি, পড়লে জানতে পারতেন, কত বাঙালি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন। সম্ভবত জানেন না যে, একজন বাঙালি লিখেছেন দেশের জাতীয় সংগীত। জানেন না, দেশে প্রথম স্বাধীন সরকার তৈরি হয়েছিল এ বাংলাতেই, একবার নয়, দুবার। তিনি জানেন না যে, বিদেশে ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে তিনটে নাম পরিচিত : সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিক। এটাও জানেন না যে, একমাত্র এ বাঙালিরাই ভাষার দাবিতে এক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে।

হ্যাঁ, বাংলাতে এখন দুদল লোকজন আছে। একদল হলো বাঙালি, দ্বিতীয় হলো বিজেপি। এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা এ চরম বাংলা বাঙালির অপমান নিয়ে একটা কথাও বলছেন না। তারা কি বাঙালি নয়, শুধুই বিজেপি? এটা তাদের এক বড় পরিকল্পনার অংশ, ‘আ গ্র্যান্ড প্ল্যান’ বাংলা ভাষাকে শুকিয়ে মারো, বাঙালিকে ভাতে মারো। এ আজ নয়, স্বাধীনতার পর থেকে চলছে; কিন্তু মোদিজির আমলে তা হয়ে উঠেছে একটা সংঘটিত আক্রমণ আর তার বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবেই রুখে দাঁড়াতে হবে প্রত্যেক বাঙালিকে।

বাংলাবাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে

অনিকেত চ্যাটার্জি : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম