Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

পালটা শুল্ক কি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক হাতিয়ার

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পালটা শুল্ক কি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক হাতিয়ার

ছবি: যুগান্তর

দেশের ভেতরে গণতন্ত্রে উত্তরণে যে আশঙ্কা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) আরোপের ভয়ংকর সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই, গড়ে ১৫ শতাংশ পালটা শুল্ক পরিশোধ করে আসছে। এ পরিমাণ শুল্ক পরিশোধে বাংলাদেশ সক্ষমতার পরিচয় দিলেও, বাংলাদেশকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বমোট ৫০ শতাংশ পালটা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করে পালটা শুল্কের এ চাপ থেকে রেহাই পাওয়া না গেলে, বাংলাদেশকে চরম বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।

আমরা সাধারণভাবে জানি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে দেশ আমদানি করে, সেই দেশের আমদানিকারকরাই আমদানি শুল্ক পরিশোধ করে। কিন্তু পালটা শুল্কের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক দেশ কোনো দেশে তাদের রপ্তানি সামগ্রী প্রবেশ করাতে চাইলে রপ্তানিকারক দেশের ব্যবসায়ীদেরকেই এ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ২০১৫ সাল থেকে নিজ নিজ সক্ষমতার ভিত্তিতে, গড়ে ১৫ শতাংশ পালটা শুল্ক পরিশোধ করে আসছিল। এখন ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক যুক্ত হলে পালটা শুল্ক হার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। এটা যে খুবই উঁচু ধরনের হার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে নতুন করে যে ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষির মাধ্যমে তা কমিয়ে আনতে দুই দফা আলোচনা হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। আগামী ১ আগস্ট থেকে এ ঘোষণা কার্যকরের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ আবারও বসতে চায়।

গত সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ সচিবালয়ে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন। তার নেতৃত্বে একটি দল পালটা শুল্ক হার কমানোর জন্য চুক্তিতে আসতে ৯ থেকে ১১ জুলাই ওয়াশিংটনে আলোচনা শেষে গত রোববার ১৩ জুলাই দেশে ফিরেছেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কিছু আলোচনার বিষয় আছে। সেগুলো শেষ করে আবার আলোচনার জন্য তিনি আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্র যাবেন। তিনি জানিয়েছেন, একটা ভালো ফলের জন্য সবাই মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে এবং বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক নির্ধারণ করবে।

কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বা কোন বিষয়ে একমত কিংবা দ্বিমত পোষণ করেছে দেশটি, সেসব বিষয়ে কোনো জবাব দেননি বাণিজ্য উপদেষ্টা। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দেশটির সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট রয়েছে। ফলে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী যুক্তরাষ্ট্র যদি স্বচ্ছতার নীতিতে ব্যত্যয় ঘটাতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গূঢ় অভিসন্ধি রয়েছে। ছোট ও দুর্বল দেশ হিসাবে এটাই আমাদের নিয়তি হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে পালটা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের জন্য এ হার ছিল ৩৭ শতাংশ। ৭ এপ্রিল ৩ মাসের জন্য তা স্থগিত করে দেশটি। এ মেয়াদ শেষ হয়ে যায় গত ৯ জুলাই। তার আগের দিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে তারা ৩৭-এর বদলে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রকে শূন্য শুল্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ কি তা দেবে? জবাবে শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ‘এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’ যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশে শুল্ক বাড়ালে বাংলাদেশকেও বাড়াতে হবে, এমন কোনো শর্ত আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাব দেননি বাণিজ্য উপদেষ্টা।

সংবাদপত্রের সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলে সেগুলোর জবাব পাননি। বাণিজ্য উপদেষ্টা ও বাণিজ্য সচিব তাদের জানিয়েছেন, পালটা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনায় বাণিজ্যের পাশাপাশি অনেক বাণিজ্যবহির্ভূত বিষয়ও আছে। তবে ৯-১১ জুলাইয়ের আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বাণিজ্যের মতো অর্থনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে অর্থনীতিবহির্ভূত শর্তাদি যোগ করতে সিদ্ধহস্ত। মোটাদাগে বলা যায়, অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ। যে স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ পূরণ হলে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর মোড়ল রাষ্ট্র হিসাবে তার অবস্থান বজায় রাখতে সমর্থ হবে।

পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের পর যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তখন তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোটেও পছন্দনীয় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র দুই বড় সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পাকিস্তানের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সেই চাপের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া অথবা হ্রাস করা, অথবা কঠিন কোনো শর্ত আরোপ করা। এর প্রতিবাদে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য জনগণ ‘ডলারের বন্ধন ছিন্ন কর’ নামে আন্দোলন করেছিল। এতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের মাঝামাঝি বিপুল মার্কিনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক ও সামাজিক ফায়দা হাসিলের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। পালটা শুল্ক নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে চাউর হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক কমিয়ে আনুক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ যেন চীন থেকে সমরাস্ত্র না কেনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেগুলো কেনে। এসব শর্তের কথা আমরা কখনোই জানতে পারব না, কারণ দুই দেশের মধ্যে ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, অথচ বাংলাদেশের জনগণ জানতে পারবে না। বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এক পর্যায়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা মন্তব্য করেন, যদি কোনো কারণে ৪০ হাজার কোটি ডলারের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে হয়; তাহলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০০ কোটি ডলারের অর্জন বিসর্জন দিতে হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ নীতির ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ০.২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৬.২ বিলিয়ন ডলার হলেও দেশটিকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে। এটি ১৪টি লক্ষ্যভুক্ত দেশের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। অথচ আরএমজি খাত থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের অধিকাংশ নারী, এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র পোশাক খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তনি বাজার, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতিতে বৈশ্বিক নিয়ম পালিত হচ্ছে না ন্যায্যতাও থাকছে না। অনুমান করা খুব বেঠিক হবে না যে, রাজনৈতিক ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ নীতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও দুর্বল অর্থনীতির ওপর এ ধরনের বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ ডব্লিউটিও’র ‘ন্যায্য ও সমান সুযোগভিত্তিক’ বাণিজ্যনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির এ ধাক্কা পোশাক খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পোশাক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত সহায়ক শিল্প ও সেবা খাতের ওপরও ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি হবে। এ খাতে অর্ডার কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে পুরো সরবরাহ ও সাপোর্ট সেক্টরে। ধাক্কাটি লাগবে কাপড়, সুতা, বোতাম, জিপারসহ বিভিন্ন এক্সেসরিজের ওপর। এ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্যাকেজিং খাত, যেমন-কার্টন, লেবেল, পলিব্যাগ প্রস্তুতকারকরা, পরিবহণ খাতও ক্ষতির শিকার হবে, যেহেতু মালামাল পরিবহণ হ্রাস পাবে। হ্রাস পাবে ট্রাক, কনটেইনার ও জাহাজের ব্যবহার। বন্দর ও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোও ক্ষতির মুখে পড়বে। মোদ্দা কথা হলো, এক ধরনের চেইন রিয়েকশান শুরু হবে, যা উৎপাদন, বিপণন, পরিবহণ ও কর্মসংস্থানকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। এ থেকে বের হতে হলে বাংলাদেশকে যথেষ্ট সৃজনশীল নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন ধরনের নীতি ও কৌশলের সুফল আসবে না, ততদিন এদেশের জনগণকে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এ দুর্ভোগের কারণ কি এই যে, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে? বাংলাদেশ যে চীন থেকে বিপুল পরিমাণে আমদানি করে, তার কারণটা খুব সহজ। চীন তার পণ্যসামগ্রী প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বাংলাদেশে রপ্তানি করে। বাংলাদেশ চীন থেকে যে সমরাস্ত্র আমদানি করে, তার জন্য অন্য অনেক উৎসের তুলনায় কম দাম দিতে হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক; বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি গভীর। তাহলেও পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। তার কারণ কি এই যে, পাকিস্তানের আণবিক অস্ত্র আছে এবং এ কারণে পাকিস্তানকে নাখোশ করতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম