নির্বাচনই পারে দেশকে আবার ঐক্যবদ্ধ করতে
সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অবদান। কারণ এ অভ্যুত্থানের কারণেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পলায়ন করেছেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, এক অর্থে প্রায় পুরো মন্ত্রিসভা এবং সংসদ-সদস্যরা যে যার মতো পলায়ন করেছেন। এরকম নজির দ্বিতীয়টি নেই। এর প্রধান কারণ শেখ হাসিনার চরম অপশাসন, দুর্নীতি, গুম-হত্যা-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার নিরন্তর চেষ্টা এবং এরকম আরও অনেক অপকর্ম। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একটি ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন সামনে রেখে ছাত্রদের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলেও এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, শিশু, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী-সবার বিপুল অংশগ্রহণ ছিল।
এ আন্দোলনে বিএনপি দল হিসাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে এবং সফলতার সঙ্গে নিজেদের কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত রেখেছে। এবং প্রতিটি কর্মসূচি দেওয়ার আগে যে গ্রাউন্ডওয়ার্ক ছাত্রছাত্রীরা করত, সেখানে ছাত্রদল সক্রিয়ভাবে তাদের ভাবনা উত্থাপন ও কার্যকর করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিনিয়ত অনলাইনে এ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি প্রদান এবং ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জনতাকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদলসহ বিএনপির প্রতিটি ইউনিটকে সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক নির্দেশনা দিতেন। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হন এবং সেদিনই চট্টগ্রামে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ওয়াসিম নিহত হন। ওই দিন মোট ৬ জন নিহত হন এবং আন্দোলনের গতিপথ এক দফার দিকে যেতে থাকে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সব পেশাজীবী সক্রিয় হন। পুরো বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষ ছিলেন একদিকে, আরেক দিকে ছিলেন নিপীড়ক হাসিনা ও তার দোসরা।
ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনা দিনের পর দিন দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু হত্যাযজ্ঞের পরিমাণ বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। ১৬ জুলাই ৬ জন নিহত হওয়ার পর ১৮ জুলাই সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৩, ১৯ জুলাই ১৭৭-এ। এভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু এত হত্যাযজ্ঞও মানুষকে দমাতে পারেনি। আন্দোলনকারীরা ঐক্যবদ্ধ থাকায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পলায়ন করেন। ওই দিন ৩৪৪ জন মানুষ হত্যার শিকার হন। আন্দোলন দমনে হাসিনার সরাসরি নির্দেশ ছিল প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার। সম্প্রতি বিবিসি প্রকাশ করেছে এ তথ্য। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শেখ হাসিনা ও ফজলে নূর তাপসের ১৮ জুলাই ২০২৪-এর এ সংক্রান্ত কথোপকথন ফাঁস হয়েছে।
শেখ হাসিনার পলায়নের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া ছিল, দেশ যে সংকটে আছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক জাতীয় নির্বাচন। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে অবিলম্বে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপি ও অন্যান্য দল সবসময়ই অনুরোধ করেছে।
এদিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষ প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন নিয়ে রাস্তা অবরোধ করতে থাকে, যা সরকারকে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পালনে বাধাগ্রস্ত করে। বিএনপি প্রতিনিয়তই সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার, যেটা এ মুহূর্তে না করলেই নয়, তা শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিতে বলে। বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের সব দল দ্রুত নির্বাচন চাইলেও দুই-একটি রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের বিরোধিতা করতে থাকে।
দেশে যে অস্থিরতা চলছে তা প্রশমনের জন্য একটি শক্তিশালী সরকার দরকার। বিএনপির দীর্ঘদিন সফলতার সঙ্গে সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকার যে কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেই কমিশনগুলোতে বিএনপি তাদের মতামত লিখিতভাবে জানিয়েছে এবং যে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে, সেই ঐকমত্য কমিশনেরও প্রতিটি সভায় অংশগ্রহণ করছে এবং সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ যখন ফ্যাসিস্টের কবলে নিষ্পেষিত, তখনই ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই, বিএনপি ৩১ দফা হাজির করেছিল। এ ৩১ দফায় বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সব উপাদানই আছে। তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে, ঐক্যের স্বার্থে, একটি গণতান্ত্রিক দেশের আকাঙ্ক্ষায় বিএনপি ৩১ দফার বাইরে গিয়েও ঐকমত্য কমিশনের অনেক প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। খুবই প্রণিধানযোগ্য দুটি বিষয় হচ্ছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর করা। বিএনপির একটি নিজস্ব রাজনৈতিক প্রস্তাবনা ছিল, কিন্তু অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে নিজস্ব তেমন কোনো প্রস্তাবনা দেয়নি। এখনো ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি সভায় বিএনপি তাদের মতামত যুক্তির সঙ্গে তুলে ধরছে।
তারেক রহমান ৫ আগস্টের পর থেকেই জাতীয় ঐক্যের প্রতি জোর দিয়ে যাচ্ছেন। প্রয়োজনে নিজের দলের কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি। বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও সরকারকে সব ধরনের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ১৭ বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। জনগণকে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য বিএনপি সর্বক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। নতুন দল হিসাবে এনসিপিকে উৎসাহ দিচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলনের সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত বসছে দেশকে কীভাবে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। জুলাই অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যও বিএনপি প্রস্তাবনা দিয়েছে। এনসিপি তরুণদের দল এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের অনেক সদস্যের যেহেতু উপস্থিতি আছে এ দলে, তাই বিএনপি এ তরুণদের দলকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশনের সভায় এবং অন্য অনেক বিষয়ে। কিন্তু কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই সেই ঘটনার কার্যকারণ পর্যালোচনা না করে দ্রুততার সঙ্গে ওই ঘটনার সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে ফেলা বর্তমানে দু-একটি রাজনৈতিক দলের মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অনৈক্যের মূল কারণ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান অস্থিরতা নিরসনের একমাত্র পথ একটি সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকার ইতোমধ্যেই এক ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। দেশকে আবার ঐক্যবদ্ধ করতে, দেশের মানুষকে একটি স্বস্তির বাংলাদেশ উপহার দিতে জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশে একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অস্থিরতা চলতেই থাকবে। তাই সব রাজনৈতিক দলকেই ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনই হবে পুনরায় ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু-সংস্কার চলমান থাকবে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী।
সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান : প্রকৌশলী
www.engr-salahuddin.com
