Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা সমাজ দেশ

স্বপ্নসারথি জুলাই বিপ্লবের গতিপথ ও বাস্তবতা

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নসারথি জুলাই বিপ্লবের গতিপথ ও বাস্তবতা

একজন মাঝি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নদীতে নৌকা বাইতে এসে গান গেয়েছিলেন এভাবে : ‘গহিন গাঙে ধরলাম পাড়ি গাঙের ঠিকঠিকানা পাইলাম না-আ-আ, উথাল-পাথাল ঢেউ রে গাঙের বাও-বাতাস তো বুঝলাম না-আ, বাও-বাতাস তো বুঝলাম না...’। গানের সুর ও ভাব আমার মনে অনুরণিত হয়, হয়তো এমন অনেকেরই হয়। এতে লেখার মূল ভাব ফুটে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই এই এক বছরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, এদেশে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ গড়ার কাজ করা কত কঠিন। কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থপরিপন্থি হলে কাজে বাগড়া দেবেই; বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর ও অপবাদমূলক কথা বিকৃতভাবে ছুড়ে মারবেই। কাজটা কোনোভাবেই করতে দেবে না। কিছু মানুষ এক জায়গায় হয়ে জোট বাঁধতে পেরেছে মানেই দেশ তাদের হয়ে গেছে। আপনিও যে এদেশের নাগরিক, আপনারও যে একটা নাগরিক অধিকার আছে, এটা বিবেচনাতেই আনবে না, বা তারাই যে তোষামোদ করে আপনাকে এনেছিল, তা ভুলে যাবে। ভাবখানা এমন, আপনাকে ব্যবহার করে তাদের ব্যবসার লাভটা ধরে নিতে চাইবে। আপনাকে যে কাজটার দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা করতে দেবে না, নিজেদের কাজটা করিয়ে নিতে চাইবে, নইলে মুখে চুনকালি মাখিয়ে দেবে, আন্দোলনের হুমকি দেবে। আমার প্রশ্ন, জুলাই-বিপ্লব কি দলভিত্তিক হয়েছিল, না সামষ্টিক স্বার্থ ও অংশগ্রহণে হয়েছিল? এ এক আজব দেশ। আজব এদের জিভ। ঘোরাতে এক মুহূর্তও লাগে না। বিবেকের দংশন শূন্যের কোঠায়। একটা কথা তাদের মাথায় ঢোকে না, জোট বাঁধলেই কি জোটের নাম ‘রাজনৈতিক দল’ বলা যায়? এ বোধও তাদের নেই। গত সপ্তাহে এনসিপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ষণ্ডা-পাণ্ডারা গোপালগঞ্জে যে কাণ্ডটা করল, এটা কি কোনো মানুষের মতো কাজ হলো? কোনো কোনো তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক বিভিন্ন মিডিয়ায় টকশোতে ইনিয়ে-বিনিয়ে কৌশলী শব্দে তাদের দিকে ঢলে পড়ছে; তাদের আত্মজিজ্ঞাসা কোথায়? আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকেও জানি তারা মেনে নেয়নি। এজন্যই তো বলে, ‘তোমার ঘাড় কেন কাত? আমরাই এক জাত’। তারা নিজেদের দলের দেউলিয়াপনা, বিকৃত মানসিকতা, আধিপত্যবাদী শক্তির দাসত্ব-কর্ম ও লুটেরা বাহিনীর কথা একটুও বিবেচনা করে না। আমাদের সমাজের ভাবধারার এমনই অবনতি হয়েছে, কোনো ডাকাত, দুষ্কৃতকারী, বিকৃত মানসিকতাধারী ব্যক্তিকে শাসন করবেন, বিচার করবেন, সে সংশোধন হবে, কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করবে?-তা করবে না; বরং উলটো ধমকাবে, নিজেকে ফেরেশতা বলে দাবি করবে, কোমর বেঁধে আবার সেই দুষ্কর্মে নামবে। আধিপত্যবাদী-শত্রুপক্ষ ও শোষকদের পক্ষ নেবে, দেশ বিক্রির দুরভিসন্ধি মনে মনে আঁকবে; তার কিছু চামচারা একযোগে তার পক্ষে গাইতে নামবে। এ আমাদের শখের বাংলাদেশ! আমাদের জন্মভূমি! একথা আমি আমার প্রায় লেখাতেই বলি, আমাদের জনগোষ্ঠী জনসম্পদে পরিণত না হয়ে জনআপদে পরিণত হয়েছে। একথা তো সর্বাংশে সত্য, যদিও সংস্কারকরা এ কথার গুরুত্ব তেমন একটা দেন না। নইলে সংস্কারের বেশকিছু দফা ভিন্ন হতো, এসব নিয়ে সংস্কারের দফা থাকত।

ইউনূস সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে দায়িত্বে আসেনি, জুলাই বিপ্লবে এদেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটা স্বপ্ন জেগেছিল, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের গ্রাউন্ডওয়ার্ক করার জন্য এসেছিল। এ সরকার যে সব দলের সব দাবি পূরণ করতে পারবে, বা পূরণ করুক, এটা আমি ব্যক্তিগতভাবেও চাই না। কারণ বিগত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতায় সাধারণ মানুষ এদেশের অধিকাংশ তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দলের’ বৈশিষ্ট্য, জনপ্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চিনে ফেলেছে। সেজন্যই বিপ্লবটা ছিল ছাত্র-জনতার বিপ্লব। এ বিপ্লব আওয়ামী রাজনীতির বিরুদ্ধেও ছিল না; ছিল তাদের দেশবিরুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরুদ্ধ, অপকর্মবিরুদ্ধ, অপহরণ-হত্যা-গুম-বিরুদ্ধ বিপ্লব; যদিও তাদের স্বার্থে পালিত কিছু গাদ্দারের কারণে বিপ্লব পূর্ণতা এখনো পায়নি। এ বিপ্লব থেকে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক কিছু শেখার ছিল। তারা শেখেনি। বিপ্লব অসম্পূর্ণতার জন্য কিছু রাজনৈতিক দলই দায়ী। সংস্কারকরা বিপ্লবের কারণ ও দেউলিয়াপনা রাজনীতিকে পথে আনতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা ভাবলে সঠিক হতো। উচ্চকক্ষ, নিুকক্ষ সৃষ্টি করে বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য সফল হবে না। আমরা প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজেদের কর্ম ও সিদ্ধান্তের দিকে তাকাই, আত্মজিজ্ঞাসা করি। আমাদের স্বার্থবাদী সিদ্ধান্তের কারণেই বিপ্লবের এ দশা। এতে লাভবান হচ্ছে দেশবিরোধীরা, যারা এদেশের সার্বভৌমত্বকে অন্য দেশের নিগড়ে বাঁধতে পারলে নিজেদের সুখী ভাবে। ভুগবে দেশ ও দেশের মানুষ। স্বল্প পরিসরের কারণে অনেক কথা বলা যায় না।

বর্তমান বড় বড় প্রতিটা দলের মধ্যেই অন্তর্™^ন্দ্ব, বহুধাবিভক্তি ও অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা। সাধারণ মানুষ চোখে দেখে, এটি হচ্ছে একমাত্র স্বার্থ-ভাগবাঁটোয়ারার কারণে। প্রত্যেক এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীর নামে ষণ্ডা-পাণ্ডাদের অত্যাচারে জনজীবন দুর্বিষহ। অনেক বাস্তব উদাহরণ আমার হাতে মজুত। এ বিষয়ের সংস্কার কই? দেশটা তাহলে কীভাবে বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ হবে? মাথায় ঢোকে না!

সংস্কার আশু প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের অশুভ-রক্তচোষা কর্মকাণ্ডকে দেশ গড়ার উপযোগী করার জন্য-উদ্দেশ্য বিচ্যুত, পথহারা রাজনীতিকে পথে আনা ও নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ব্যবস্থা প্রভৃতি। এর কতটুকু সার্থক হবে, এটাই বিবেচ্য। সংস্কারকদের এদিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হতো, হয়নি।

জাতীয় সরকারব্যবস্থার কথা, বিদ্যমান সব দলের মতৈক্যের কথা, রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের কোড অব এথিক্স তৈরির কথা, রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড পচে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাওয়াতে দেশ পরিচালনায় এ দেশের অরাজনৈতিক পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘জাতীয় কাউন্সিল’ গঠনের কথা অনেক লেখায় বলেছিলাম, কোনো কিছুই তো হবে বলে মনে হচ্ছে না; এমনকি জুলাই-চার্টারও পূর্ণাঙ্গ হবে কিনা সন্দেহ আছে।

বর্তমান সরকার এসব না করে রাজনৈতিক দলগুলোর তোয়াজের দিকে বেশি দৌড়াচ্ছে। জানবেন, তারা কখনো দেশের কল্যাণের কথা ভেবে পথে আসবে না। এদের রাজনৈতিক দর্শনটাই ভিন্ন ও উলটা। তারা ‘তালগাছটা’ পকেটে ভরে তারপর বিচারে বসবে। তারা দেশের কল্যাণে রাজনীতিতে আসেনি; উদ্দেশ্য মুখের কথার সঙ্গে ভিন্নরূপ, ‘চাটার দল’ পোষা ও ক্ষমতা। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী অবস্থায় দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দেশ-শোষণ, সন্ত্রাস কীভাবে হচ্ছে-প্রতিদিনের পত্রিকায় তা দেখছি। সাধারণ মানুষ নিজ চোখে তা দেখছে ও ভুগছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নেই কেন? যে দলই ক্ষমতায় আসুক, এ স্বভাব কি এক রাতের মধ্যে কোনো জাদুর ইশারায় বন্ধ হয়ে যাবে? আমরা আত্মসংশোধনের দিকে মনোযোগী হই না কেন? রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাধারা ও কাজের প্রকৃতি পরিবর্তন না হলে সংস্কার করে কী লাভ? নতুন বাংলাদেশইবা কীভাবে গড়বে?

বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। এখন পর্যন্ত যতটুকু বোঝা যাাচ্ছে, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, উভয়টির নির্বাচকমণ্ডলীও একই থাকছে। আবার এদেশে প্রাদেশিক সরকারও নেই। এমন অবস্থায় ক্ষমতায় ভারসাম্য কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা করা সময়ের দাবি। উচ্চকক্ষের নির্বাচকমণ্ডলী নিয়ে নতুন কিছু ভাবা যায় কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। সংস্কারকরা এ নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন। রাষ্ট্রপ্রধান ও তার ‘জাতীয় কাউন্সিল’ এবং রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ব ও কর্মের ভারসাম্য তৈরির কোনো ব্যবস্থা করা গেলে সত্যিকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হতো। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগসহ অন্যান্য বিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেক সুবিধাজনক ও ভারসাম্যপূর্ণ হতো। যাত্রা প্যান্ডেলে বিবেককে টানা সুরে গাইতে শুনেছিলাম, ‘পথিক আপন বুঝে চলো, এ-এ-এই বেলা-আ’।

ড. হাসনান আহমেদ : সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম