Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কেন শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার প্রয়োজন

Icon

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেন শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার প্রয়োজন

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্থলপথে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনা থাকার পরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেরও অন্তর্ভুক্ত। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এ অঞ্চলের ভবিষ্যতে বিশ্ব নেতৃত্বে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দেশগুলো সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি এবং তা ব্যবহার করতে পারলে উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা ত্বরান্বিত হবে। আসিয়ান দেশগুলো সম্মিলিত ও স্বতন্ত্রভাবে তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বজায় রেখেছে, কিন্তু দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি কার্যকর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্মের অভাব থাকায় তারা সেই সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে না। মিয়ানমার ছাড়া এ অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও দেশগুলো দৃশ্যত শান্তিতেই ছিল। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের চলমান সংঘাত শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা

২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর ভারত ৭ মে ‘দ্য অপারেশন সিঁদুরে’র মাধ্যমে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর পরপরই পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক স্থাপনাগুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলাসহ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। ১০ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। উভয় দেশ একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করায় সম্পর্কের অবনতি হয়। পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক না হওয়ায় এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে।

ভারত

ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সংযোগ, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে ত্রিপক্ষীয় হাইওয়ে প্রকল্প এবং কালাদান মাল্টিমডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। ভারত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকা কালাদান প্রকল্পের নির্মাণ কার্যক্রম আবার শুরু করেছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে বাণিজ্য সহজতর করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্তকারী ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্প ও অন্য অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। ভারতের ঋণ সহায়তার আওতায় টেলিযোগাযোগ, রেলপথ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও কৃষির সহায়তা প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি সিতওয়ে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

চীন

মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের দৃঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান। চীন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে মিয়ানমারকে সমর্থন করে। রাখাইন রাজ্যে চীনের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইনে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চকপিউতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশ একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের অন্তর্ভুক্ত। চীন মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, চীন মিয়ানমারে তার স্বার্থরক্ষার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গেই আলোচনা করে। মিয়ানমার সরকার ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি সুরক্ষা পরিষেবা আইন জারি করে, যা চীনা বেসরকারি সুরক্ষা সংস্থাগুলোকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোসহ চীনের স্বার্থরক্ষার জন্য মিয়ানমারে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করার বিষয়ে অনুমতি দেয়। চীন তার সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্রাদারহুড জোটের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। চীন ও ভারত উভয়েরই মিয়ানমারে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। উভয় দেশই সম্ভাব্য সব উপায়ে তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা করছে।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশ গত আট বছর ধরে মিয়ানমার থেকে আসা ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করে চলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশ এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে পারছে না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তার অর্থ হ্রাস পাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক এবং এর পাশাপাশি নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বিদ্যমান মানবিক পরিস্থিতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। রাখাইনে আরাকান আর্মির কাছে বর্তমানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাচার হতে পারে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে। বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়, এরপর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য টানাপোড়েন দেখা দেয়, যা এখনো চলমান। ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে আনুমানিক ৭৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এটি মোট দ্বিপাক্ষিক আমদানির প্রায় ৪২ শতাংশ। এপ্রিলে ভারত নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশি রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিছুটা চাপের মধ্যে থাকলেও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।

মিয়ানমার

মিয়ানমার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমৃদ্ধি এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে মৃত্যু, ধ্বংস, বাস্তুচ্যুতি এবং শরণার্থী পরিস্থিতি বেড়ে চলেছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও চলমান সংঘাত মানবিক সংকট এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। সামরিক জান্তা বেসামরিক নাগরিক ও অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পরও শান্তির সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং আরও অনেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।

আরাকান আর্মি বাংলাদেশসংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকাসহ রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে ও চকপিউ বন্দরের মতো কৌশলগত অবস্থানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে এবং এ আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা এবং স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এখনো নিয়মতান্ত্রিক নির্যাতন, নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হচ্ছে। প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে খোলা আকাশের নিচে ক্যাম্পে বন্দি রাখা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তারা ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাশ এবং বিবৃতি জারি করেছে। শান্তি ও স্থিতিশীতার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

মিয়ানমার কৃষি, জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। মিয়ানমারে প্রাকৃতিক গ্যাস ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যের সম্ভাবনা ব্যাপক। স্থিতিশীল মিয়ানমার আসিয়ানের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখতে সক্ষম এবং একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এ উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে পারে। মিয়ানমারে শান্তি এ অঞ্চলে মাদক ও অস্ত্র পাচারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে; বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডে শরণার্থীদের প্রবাহ বন্ধ করবে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জঙ্গিবাদ ও বিদ্রোহের বিস্তার রোধ করবে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাজনৈতিক সমাধান ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও মানবিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট চলমান রেখে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

মিয়ানমারে শান্তি ফিরে এলে অবকাঠামো ও পরিবহণের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়ানো সম্ভব হবে, দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্য আরও সুসংহত হবে, জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং নিরাপত্তা হুমকি হ্রাস পাবে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের এ রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ অঞ্চলের জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগগুলো খুঁজে বের করার এবং তা কাজে লাগানোর সময় এসেছে। মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা শক্তিশালী করবে এবং শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিনির্মাণে অবদান রাখবে।

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.) : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম